অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে ১৫ জন বিচারকের সম্পদের তথ্য চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিষয়ে তদন্ত করতে আইনগত কোনো জটিলতা আছে কি না বা দুদক সরাসরি তাদেরকে চিঠি দিতে পারে কি না সেটি নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। আইনজ্ঞরা বলেছেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে । যদিও এক সময় নিয়ম ছিল কোনো সরকারি চাকরিজীবী জজ ম্যাজিষ্ট্রেটের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গেলে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হতো। এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছেন।
কেউ বলছেন, জজ ম্যাজিষ্ট্রেটদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে আইনগত কোনো বাধা নেই। আবার কেউ কেউ বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে এমন তদন্ত করা যাবে না যেটি হয় রাজনৈতিক হয়রানির মতো বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়।
বিজ্ঞাপন
জজদের সম্পদের অসঙ্গতি থাকলে তার হিসাব চাওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকারি চাকরীজীবী জজ ম্যাজিষ্ট্রেটদের সম্পদের হিসাব চাইতে আইনগত কোনো বাধা নেই। আগে নিয়ম ছিল সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে দুদক কোনো তদন্ত করতে গেলে সরকারের পূর্বানুমতি লাগতো। কিন্তু সেটি এখন পরিবর্তন করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও আছে। রায়টিতে ৬৫ ডিএলআরের ২৭৯ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত বলা আছে।
বিচরকদের বিরুদ্ধে তদন্তে কেউ যেন পলিটিক্যাল মোটিভেটেড না হন, বিচারকরা যেন হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়ে খেয়াল রেখে অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত কাজ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশে’র চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ।
তিনি বলেন, অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ থকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হোক। এতে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কারণ যিনি দুর্নীতি করবেন তার বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা দরকার। তদন্তের সব প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অবলম্বন করতে হবে। প্রোপার অথরিটির মাধ্যমে চিঠি দিতে হবে। বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
এই আইনজ্ঞ আরও বলেন, ‘তদন্তটা যেন রাজনৈতিক না হয়। কনফিডেনশিয়াল হতে হবে। বর্তমান সরকারের সময় অনেক সিদ্ধান্ত পলিটিক্যাল মোটিভেটেড হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে আবার কেউ কেউ পার পেয়ে যাচ্ছেন। এমনকি প্রমোশন পাচ্ছেন। বিচারকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে জুডিশিয়াল ইনভেস্টিগেটিভ সার্ভিস চালু থাকলে এটা আরও ভালো হতো।’
সম্প্রতি কয়েকজন বিচারকের সম্পদের তথ্য চেয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিটি সচিবের দফতরে পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা, ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) রেজাউল করিম চৌধুরী ও সাবেক অতিরিক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) মুহাম্মদ আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
তাদের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ঘুষ গ্রহণ, অপরাধমূলক অসদাচরণ ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
আরও বলা হয়ে, অভিযোগটির সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে আরও ১৫ জন বিচারকের সম্পদ বিবরণী ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ওই ১৫ জনের সর্বশেষ দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী, ব্যক্তিগত নথির ফটোকপি ও ব্যক্তিগত ডাটাশিটের সত্যায়িত ফটোকপি ২৯ এপ্রিলের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ও উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ মাল মামুনের সমন্বয়ে গঠিত টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে।
দুদকের চিঠিতে যে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে সাবেক যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহাসহ ওই তিনজনের নামও রয়েছে। চিঠিতে ১৫ জনের নাম পদবি উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন- আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা, ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) রেজাউল করিম চৌধুর, সাবেক অতিরিক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, কুষ্টিয়ার নারী ও শিশু নির্ঘাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শেখ গোলাম মাহবুব, কিশোরগঞ্জের নারী ও শিশু নির্ঘাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মাহবুবুর রহমান সরকার, সিলেটের সাবেক জেলা জজ মনির কামাল, সাবেক ঢাকা মহানগর আদালতের সাবেক অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন, মাগুরার সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজ মুশফিকুর ইসলাম, গাজীপুরের সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাইসারুল ইসলাম, নরসিংদীর সবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা সাইফুল আলম, ময়মনসিংহের সাবেক বিশেষ জজ ফারহানা ফেরদৌস, শেরপুরের নারী ও শিশু নির্ঘাতন ট্রাইব্যুনালের সাবেক জজ কামরুন নাহার রুমি, ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজ শওকত হোসেন, সিরাজগঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ এরফান উল্লাহ ও হাবিগঞ্জ জেলা জজ সাইফুল আলম চৌধুরী।
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন বিচাপরপতির বিরুদ্ধে পেশাগত অসদাচারণের অভিযোগ আনা হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ পদত্যাগ করেন। আবার কাউকে কাউকে বিচার বিভাগ থেকে করা হয় অপসারণ।
এআইএম/ইএ