মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের আবেদনের ওপর আংশিক শুনানি হয়েছে। এ মামলার শুনানি আগামীকাল (২৬ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আপিল বিভাগ।
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
বিজ্ঞাপন
মামলাটি বুধবারের (২৫ ফেব্রুয়ারি) কার্যতালিকার প্রথম দিকে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
আজ আদালতে আজহারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী। এসময় উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান, আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, নাজিব মোমেন, এসএম কামাল হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, জসিম উদ্দিন সরকার, ড. মুহাম্মাদ হেলাল উদ্দিনসহ জামায়াত পন্থি অনকে সিনিয়র আইনজীবী। অন্যদিকে এদিন আদালতের আইনজীবীর বাইরে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
এদিকে আদালত মতামত দিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ডাকা হলে তিনিও তার মতামত ব্যক্ত করেন।
পরে আদালত থেকে বেরিয়ে বিস্তারিত জানান জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, আপিল বিভাগ এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। আমরা এর বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেছিলাম। আজকে তার আংশিক শুনানি হলো। আগামীকাল সকালে আবার টপমোস্ট আইটেম হিসেবে এটির শুনানি হবে। আজকে শুনানির এক পর্যায়ে আপিল বিভাগ সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের কাছে অ্যাডিশনাল গ্রাউন্ডস চেয়েছেন। কোন কোন গ্রাউন্ডে রিভিউ করা হবে। আমরা সাতটি গ্রাউন্ডস তৈরি করেছিলাম। সেই গ্রাউন্ডের কপি আদালতে দাখিল করা হয়। এই গ্রাউন্ডসে লিভ হবে কি হবে না সেই মর্মে আগামীকাল শুনানি হবে।
বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, শুনানি অন্তে আদালত পরবর্তী আদেশ প্রদান করবেন। মূলত তৎকালীন আদালত ওনাকে তিনটি ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিল। ওই মামলায় আরেকজন মাননীয় বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ করে তাকে খালাস দিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, এই বিষয়গুলো এই রিভিউ আবেদনে ওঠে এসেছে। এখানে মূল প্রশ্ন ওঠেছে, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালে প্রযোজ্য হবে না মর্মে অতীতের আদালত বলেছিল। এই যে আন্তর্জাতিক আইন এখানে প্রযোজ্য হবে না- এই কথা বলে যে রায় দেওয়া হয়েছে; এটা শুধু এটিএম আজহারুলের ক্ষেত্রে নয়, জনাব কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামী, কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাসেম আলীর ক্ষেত্রে এই আন্তর্জাতিক আইনের প্রথাগত বিধান প্রযোজ্য নয় মর্মে রায় দিয়েছে। আজকের রিভিউ পিটিশনের আলোচনায় সেই বিষয়টি এসেছে। অতীতের সবগুলো রায়ে সেই সময়ের আদালত এই যে ফাইন্ডিংস দিয়েছিল। সেই ফাইন্ডিংস অনুযায়ী এই মানুষগুলোকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তা কার্যকর করা হলো। আজকে যদি সেই রায়গুলো এই গ্রাউন্ডে রিভিউ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের অ্যাপ্লাই না করার কারণে যে অবিচার হয়েছে, সেটা নতুন করে আবার প্রমাণিত হবে।
তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে এই আপিলটি সরাসরি দায়ের করা হয়েছিল। ওই আপিলটি খারিজ করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে। এখন প্রশ্ন ওঠেছে এই আপিলের বিরুদ্ধে যে রিভিউটি দায়ের করা হয়েছে- এখানে কোন লিভ গ্রাউন্ড করতে হবে আগে; নাকি সরাসরি রিভিউ পিটিশনটি এলাউ করতে পারবে? এই প্রশ্নে সিনিয়র আইনজীবী প্রবীর নিয়োগীর মতামত শুনেছেন আদালত। প্রবীর নিয়োগী বলেছেন, লিভ মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে অতীতের নজির আছে। লিভ গ্রান্ড (মঞ্জুর) না করেও সরাসরি রিভিউ পিটিশন মঞ্জুর করা যায় কি না এই বিষয়ে আমরা আগামীকাল আমাদের মতামত তুলে ধরব।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, এখানে প্রশ্ন ওঠেছে কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ ছাড়া অর্থাৎ প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের বিধান ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো বিচার করা সম্ভব নয়। এই কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ আইনে বিচার হয়েছে সিয়েরেলিয়নে, এই আইনে বিচার হয়েছে রুয়ান্ডাতে, এই আইনে বিচার হয়েছে ইয়োগোস্লাভিয়াতে, এই বিচার হয়েছে টোকিওতে। সব জায়গায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রামইস ট্রাইব্যুনাল যারা ছিল তারা কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ অ্যাপ্লাই করে বিচার করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের কোর্ট এসে বলেছে এটা একটা ডোমিস্টিক (দেশীয়) ট্রাইব্যুনাল। এখানে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনের প্রযোজ্যতা নাই। আজকে আমরা আদালতে সেই প্রশ্নই তুলেছি যে, আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনের প্রযোজ্যতা ছাড়া অর্থাৎ ওই আইনের বিধানের প্রযোজ্যতা ছাড়া এই মামলার বিচার করা পসিবল নয় এবং যা করা হয়েছে তা আইন সম্মতভাবে করা হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, কেন বিচারপতির আন্তর্জাতিক আইনের বিধানকে বাতিল করতে হলো।
‘আমরা বলেছি আন্তর্জাতিক আইনের বিধান যদি মানা হয়, তাহলে যাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে এভাবে রায় কার্যকর করা হয়েছে। তখন সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ জন্যই তারা আন্তর্জাতিক আইনের বিধানকে অ্যাপ্লাই না করে দেশীয় আইনের বিধানকে অ্যাপ্লাই করার চেষ্টা করেছেন। কারণ হচ্ছে এই আইনে (দেশীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) বলা আছে- সাক্ষ্য আইন ও ফৌজাদারি কার্যবিধি অ্যাপ্লাই করা হবে না। যদি সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি অ্যাপ্লাই করা না হয়, তাহলে বিচারটা করা হবে কোন আইনে- সেক্ষেত্রে আমরা বলেছিলাম প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে। কারণ আমাদের এই ট্রাইব্যুনালের নাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আজহার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপিল করেন।
পরে আজহারুল ইসলামের করা আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। পরে ২০২০ সালের ১৫ মার্চ এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। এর পরদিন ১৬ মার্চ তার মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করেন।
এআইএম/ইএ

