টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনা সরকার বিরোধী মত-পথ দমনে ছিল বেপরোয়া। সরকারবিরোধী কেউই তাদের রোষানল থেকে রেহাই পায়নি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটেছে শেখ হাসিনার। নতুন দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত দিনের গুম-খুনসহ সব অন্যায়ের বিচারের ঘোষণা দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে অন্তবর্তীকালীন সরকার গণহত্যার বিচারের জন্য ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারকে অভিযোগ দাখিলের আহ্বান জানিয়েছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে গুম-খুন ও গুলির মতো অভিযোগের বিচার চাইতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শরণাপন্ন হয়েছে ছাত্রশিবির।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনালে দুটি অভিযোগ দাখিল করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। এদিন কৃত্রিম পায়ে হেঁটে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এসে ভিকটিম ছাত্রশিবির নেতারা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার বর্ণনা দেন। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সহকারী আইন সম্পাদক আমানুল্লাহ আদিব।
অভিযোগ দায়েরের পর শিবিরের আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসন আমলে ছাত্রশিবিরের ওপর সর্বোচ্চ বর্বরতা চালানো হয়। অভিযোগ দায়েরকারী চার শিবির নেতা এই বর্বরতার শিকার। পুলিশের বর্বর নির্যাতনের কারণে তাদের পা কেটে ফেলা হয়েছে এবং কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে।
এই নেতা বলেন, ছাত্রশিবিরের দায়িত্ব পালন করার কারণে এই সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে। এইরকম অসংখ্য নজির ছাত্রশিবিরের জনশক্তিতে রয়েছে। আমরা সেগুলো ক্রমন্বয়ে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব। তাদের ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসব।
আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, জয়পুরহাটের ১২ জন এবং চৌগাছা থানার নয়জন র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
ভিকটিম শিবির নেতা আবুজর গিফারী বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনকালে ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীর ওপর জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে। এই নির্যাতনের বিচারের প্রক্রিয়া স্বরূপ আজ আমরা এখানে এসেছি। আমাদের ওপর যে অন্যায় হয়েছে, যে জুলুম নির্যাতন হয়েছে, সেগুলোর বিচার নিশ্চিত করার জন্য এখানে এসেছি।
আবুজর গিফারী বলেন, পায়ে গুলি করার পর শুধু ড্রেসিং ও রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের ভাইয়েরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। বারবার আবেদন করার পরও আমাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। অবশেষে আমাদের পাগুলো বিনা চিকিৎসায় পচে যায়। পরে ঢাকায় এসে ডাক্তার সিদ্ধান্ত দেন পা পচে গেছে, কেটে ফেলতে হবে।
জয়পুরহাটের দুই শিবির নেতা অভিযোগে যা বললেন
ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, আবুজর গিফারী জয়পুরহাটের তৎকালীন জেলা সভাপতি এবং ওমর আলী ছিলেন তৎকালীন জেলা সেক্রেটারি। ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর জেলা শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য জয়পুরহাট থেকে হানিফ বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। আব্দুল্লাহপুর এলে ৯ ডিসেম্বর সকাল ৬টার দিকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে দুজনকেই মাইক্রোবাসে উঠিয়ে উত্তরা র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৫ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে তাদের মাইক্রোবাসে করে হাত এবং চোখ বেঁধে রাজশাহী র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৫ ডিসেম্বর রাত এবং ১৬ ডিসেম্বর সারাদিন আবারও চালানো হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। ১৬ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে রাজশাহী থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচবিবি থানার শিমলতলী এলাকায়। সেখান থেকে তাদের সঙ্গে বোমা ও অস্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাদের রাত ৪টার দিকে জয়পুরহাট র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় আবারো শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন। এরপর সকাল ১০টার দিকে অস্ত্র এবং বোমাসহ সংবাদ সম্মেলন করে জয়পুরহাট র্যাবের তৎকালীন মিডিয়া উইং। দুপুরে পাঁচবিবি থানার কাছে তাদের অস্ত্র মামলা দিয়ে হস্তান্তর করা হয়।
এরপর সেখানে রাত ২টা পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশ নির্যাতন চালায়। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে তাদের হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় আওলায় ইউনিয়নের একটি পরিত্যক্ত জায়গায়। পুলিশ দুজনের হাঁটুতে গুলি করে পা ঝাঁঝরা করে দেয়। তাদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে রেফার করেন। সেখানেও তাদের চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে অপারেশন করে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়। দুইজনেরই প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় মাংস ৭৫ শতাংশ পচে যায়। ফলে ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ দুজনের অনুমতিসাপেক্ষে দুটি পা কেটে ফেলা হয়। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলে ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জয়পুরহাট কারাগারে পাঠানো হয়।
যশোরের দুই শিবির নেতাকে নিপীড়নের নৃশংস ঘটনা
মো. রুহুল আমিন ইসলামী ছাত্রশিবিরের যশোর জেলা পশ্চিম চৌগাছা উপজেলা শাখার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ইস্রাফিল হোসেন একই থানা সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট সাংগঠনিক কাজ শেষ করে রুহুল আমিন বাড়ি যাওয়ার পথে বন্দুলীতলা শফি মল্লিকের ইটভাটার মোড় থেকে চৌগাছা থানার একজন এসআই এবং দুজন এএসআই তাদের গ্রেফতার করে চৌগাছা থানায় নিয়ে যায়। ৪ আগস্ট তাদের ডিবি কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের আবার চৌগাছা থানায় নিয়ে আসার পথে কয়ারপাড়া এলাকায় এলে দুজনেরই দুই হাত পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাপ পরানো হয় এবং চোখ বেঁধে ফেলা হয়।
গভীর রাতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বন্দুলিতলার নির্জন মাঠে। সেখানে নিয়ে দুজনের হাঁটুতে পুলিশ গুলি করে পা ঝাঁঝরা করে দেয়। সেখান থেকে তাদের উপজেলা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই তাদের রেফার করা হয় যশোর সদর হাসপাতালে। সেখানে দুই দিন চিকিৎসার পর কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাদের ঢাকার পঙ্গু হসপিটালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভর্তি হওয়ার সাত দিন পর পায়ে পচন ধরলে ডাক্তার পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন এবং পা কেটে ফেলা হয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করে যে, বন্দুকযুদ্ধে দুই শিবির নেতা আহত। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা রুজু করে দুই মাস চিকিৎসার পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে।
এর আগে গত ২২ অক্টোবর ছাত্রশিবিরের পাঁচ নেতা গুমের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করে তাদের পরিবার। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তারা গুম হন বলে জানান পরিবারের সদস্যরা।
এআইএম/জেবি