ন্যায়বিচার না পাওয়া সুশাসনের অন্তরায়। এতে বেড়ে যায় অপরাধের মাত্রা। ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বিচার বিভাগের। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে মামলা করাও উচিত নয়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। তার দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাকর্মীরাও পালিয়ে যান। অনেকেই আটক হন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। এরপর শুরু হয় জুলাই গণহত্যার অভিযোগে বিভিন্ন মামলা, যেগুলোতে আসামি করা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ অনেক সাংবাদিককেও।
বিজ্ঞাপন
প্রশ্ন উঠেছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কেন এত মামলা? অভিযোগ ছাড়াই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা হচ্ছে? এজাহারে মামলার বাদীরা কি অভিযোগ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে? এসব বিষয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা হয় বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, সাংবাদিকদের মতামত দেওয়া বা তাদের নিউজের কারণে যদি কোনো অপরাধ সংগঠিত হয় তাহলে তার দায়ভার তাদেরকেই নিতে হবে৷ ভুক্তভোগীরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন৷
স্বাধীন সাংবাদিকতায় দেওয়া মতামত কারও পক্ষে বা বিপক্ষে যেতেই পারে, তাই বলে কি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাংবাদিকরা বসে যে মতামত দিয়েছেন সেটি কি গঠনমূলক বক্তব্য ছিল নাকি উস্কানিমূলক ছিল? তাদের উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণেই দেশে গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। এর দায়ভার তাদেরকেই নিতে হবে।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ বলেন, গণহত্যায় যদি কোনো সাংবাদিক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কারও বিরুদ্ধে যদি অপরাধ করা বা অপরাধ উসকে দেওয়ার মতো ভূমিকা থাকে তাহলে সেসব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি গণহত্যায় উস্কানিমূলক বক্তব্য না দিয়ে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। অহেতুক কাউকে জড়িয়ে মামলা দিলে সেটি হবে হয়রানিমূলক।
বিজ্ঞাপন
এই আইনজীবী আরও বলেন, গত ৫ আগস্টের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণআন্দোলন নিয়ে সাংবাদিকরা মিটিং করেছেন যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিউজ আকারে এসেছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, যারা ওই মিটিংয়ে ছিলেন না তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হতে পারে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করে হঠকারিতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য নির্ভয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। সাংবাদিকদের মতামত জনগণের পক্ষে বা বিরুদ্ধে যেতে পারে। তাই বলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না। তাদেরকে হয়রানি করা যাবে না। ৫ আগস্টের পর গণহত্যার অভিযোগে যেসব সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তা মোটেও ঠিক হয়নি। এগুলো করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ইমেজ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সাংবাদিক অপরাধ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। বিচারও হতে পারে।
গত ২৪ জুলাই শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে যা বলেছিলেন সাংবাদিকরা
দেশব্যাপী নাশকতা ও নৃশংসতার ঘটনায় কোনো অপরাধীকে ছাড় না দেওয়ার দাবি জানিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে জামায়াত-বিএনপি কর্তৃক সংঘটিত ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব ব্যর্থ করতে গোয়েন্দা প্রতিবেদন বাস্তবায়নে কোনো ব্যর্থতা ছিল কি না, সে প্রশ্ন তোলেন তারা।
ছাত্রলীগে আরও মেধাবী শিক্ষার্থীদের যোগদানে আকৃষ্ট করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালীকরণ এবং জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের ওপর গুরুত্বারোপও করেন তারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে মতবিনিময় সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকরা এসব কথা বলেন। এডিটরস গিল্ডের উদ্যোগে এ আয়োজনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও হেড অব নিউজ উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকরা বলেন, তারা শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত।
রাজধানীর মহাখালীতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার কথা তুলে ধরে ‘ডিবিসি’র সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, বেলা তিনটার পর সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য ছিলেন না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য সেখানে ছিলেন না এবং কেন একজন কর্মকর্তা তার বাহিনী নিয়ে জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন? তিনি আরও বলেন, গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল এবং সে কারণেই পুলিশ রাজধানীর আশপাশে চেকপোস্ট বসায়। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানীতে কোনো পিঁপড়া প্রবেশ করতে পারবে না, অথচ হাতি প্রবেশ করেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য আত্মসমালোচনা করার পরামর্শ দিয়ে পিন্টু বলেন, গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অফিস রক্ষায় কেন সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজন পড়ল।
ভোরের কাগজ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের নৃশংসতায় দলের দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। দলে রদবদলের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও তদারকির পরামর্শ দেন এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনার ওপর জোর দেন।
ডিবিসির এডিটর ইন চিফ ও সিইও মনজুরুল ইসলাম সাম্প্রতিক ঘটনা কেন্দ্র করে আত্মসমালোচনা করার এবং জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করার পরামর্শ দেন।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আছেন এবং তার জন্য যা প্রয়োজন তা করতে পারেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করার সময় এসেছে। কারণ, তারা এখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের যন্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
চট্টগ্রামে মামলা, যা বলছেন সাংবাদিক নেতারা
চট্টগ্রামে ২৮ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাংবাদিকদের আটটি সংগঠনের নেতারা। ৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে এক যৌথ বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানান তারা। এ মামলা পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছেন তারা।
সংগঠনগুলো হলো— বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি, চট্টগ্রাম টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রাম ও টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন।
বিবৃতিতে অবিলম্বে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান সাংবাদিক নেতারা। তারা বলেন, সাজানো এ মামলা সাংবাদিকদের সামাজিকভাবে অপদস্থ ও হেয় করার অপচেষ্টার অংশ।
তবে অহেতুক কাউকে গ্রেফতার ও হয়রানি না করতে সম্প্রতি একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সরকার যখন বিচারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘকে সত্য অনুসন্ধানে আহ্বান জানিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় কিছু অতি উৎসাহী ও স্বার্থান্বেষী মহল আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এবং প্রতিবাদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোরপূর্বক পদত্যাগ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বেআইনি তল্লাশি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ, আদালতে আসামিকে আক্রমণ করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
সরকার সবাইকে আশ্বস্ত করতে চায়, মামলা হওয়ার অর্থ যত্রতত্র গ্রেফতার নয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী এসব কার্যকলাপের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার সব দুষ্কৃতকারীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অচিরেই অভিযান চালাবে এবং দলমত-নির্বিশেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইতিমধ্যে গণহত্যার অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন সাংবাদিক ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন থানায় খুনের অভিযোগেও মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।
এআইএম