মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় কতটুকু সম্ভব

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৩:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় কতটুকু সম্ভব

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষার জন্য কত আন্দোলন সংগ্রাম। ঐতিহাসিক ৫২’র  ভাষা  আন্দোলন সারা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী দিবস হিসেবে প্রতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় মাতৃভাষা দিবস। বাড়ছে বাংলা ভাষার ব্যবহার,গবেষণা ও ভাষার চর্চা। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিন্নতা। বাংলা ভাষার ব্যবহার একদমই কম এখানে। এতে করে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন অর্ধ-অল্প শিক্ষিত বিচারপ্রার্থীরা।

আইনজ্ঞরা বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার ব্যবহার সময়ের দাবি। তাদের মতে, বাংলা ভাষায় উচ্চ আদালতের রায় হলে বিচারপ্রার্থীদের জন্য অনেক সুবিধা হবে। কারণ নিজের মাতৃভাষায় যেকোনো বিষয় বুঝতে সুবিধা হয়, অন্য ভাষায় তা কঠিন। একইসঙ্গে আগামী দিনের নতুন আইনগুলো বাংলা ভাষায় করার দাবি জানান তারা।


বিজ্ঞাপন


সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, জনস্বার্থে হলেও উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় লেখা উচিৎ। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, আমাদের নিজস্ব ভাষায় বিচারকার্য পরিচালনা হলে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী উভয়ের জন্য সুবিধা। কারণ মাতৃভাষায় কোনো বিষয় বুঝতে সহজ, অন্য ভাষায় কিছুটা কঠিন। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে এখন যেসব আইন আছে অধিকাংশই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রণয়ন করা।

জানতে চাইলে সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, পাবলিক লিটিগেশনের কথা চিন্তা করলে বাংলায় রায় ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা আছে। পাশাপাশি ইংরেজিতে রায় ঘোষণা করা যেতে পারে। কিন্তু এতে কিছু সমস্যা আছে। আমাদের দেশের উচ্চ আদালত রায় ঘোষণার সময় ভারত ইংল্যান্ডসহ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর রেফারেন্স ফলো করেন। এজন্য ইংরেজিতে রায় ঘোষণা করা হয়।

এই আইনজীবী আরও বলেন, আমাদের সিস্টেমের ডেভেলপ (উন্নয়ন) করতে হবে। এরপর ধীরে উচ্চ আদালতের রায় ও আদেশ বাংলায় দেওয়া সম্ভব হবে।  

অল্প-অর্ধ শিক্ষিতদের জন্য বাংলা ভাষায় রায় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকেই। তাদের মতে, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এ ভাষাতেই আমরা কথা বলি। মনের ভাব প্রকাশ করি। আদালতের রায় বা আদেশ বাংলায় হলে সবার জন্য বোঝা অনেক সহজ হতো। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, উচ্চ আদালতের ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় রায় দিলে ভালো হয়। কারণ বাংলাটা সবাই সহজেই বুঝেতে পারি। অর্থাৎ যিনি ভুক্তভোগী তিনি তার রায়টা বাংলা পড়ে পরবর্তী আইনী পদক্ষেপ নিতে পারবেন, খুব সহজেই।

সর্বোচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় ব্যবহার নিয়ে রিটকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ ঢাকা মেইলকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের রুলস এখনো ইংরেজিতে রয়েছে। আমি মনে করি এই রুলস বাংলায় করা উচিত। তাতে বিচারপতি ও আইনজীবীরা বাংলা ব্যবহারের উৎসাহিত হবে।

এদিকে দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে বাংলা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিভিন্ন মামলা, রিটসহ অন্যান্য আবেদনসমুহ লেখা হয় ইংরেজিতে। আদালতের কার‌্যতালিকা, সুপ্রিম কোর্ট রুলসেও পরিবর্তন আনা হয়নি। সর্বত্রই চলছে ইংরেজি। এযেন বাংলা মায়ের বুক দখল করেছে ইংরেজি। দেশের এই সর্বোচ্চ আদালতের উভয় বিভাগেই ইংরেজির জয়জয়াকার। তবে মহান ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে দুয়েকটি বেঞ্চে ব্যবহার হচ্ছে বাংলা ভাষা।

মহান ভাষার মাস ফেব্রুয়ারীকে সামনে রেখে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। এই আদালতে গিয়ে দেখা গেছে এ মাসকে কেন্দ্র করে বিগত দিনগুলোতে বিভিন্ন মামলায় যেসব  আদেশ ও রায় ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো বাংলা ভাষায়। যদিও বছরের অন্যান্য মাসে ইংরেজিতে রায় ঘোষণা করেন এই কোর্টের বিচারপতিরা। জানতে চাইলে এই বেঞ্চের একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, মহান ভাষার মাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমাদের কোর্টের স্যারেরা বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন।

আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নিয়ে একটি রিটের রুল জারির প্রায় তিন বছর পার হলেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।

আদালতের ভাষা হিসেবে প্রথমে বাংলা এবং পরে অন্য ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও উচ্চ আদালতের সর্বস্তরে প্রয়োগ নেই বাংলা ভাষার ব্যবহার। তবে কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাংলায় প্রকাশ করতে বিদেশ থেকে আনা হয়েছে সফটওয়ার। কয়েকজন বিচারপতি ব্যক্তিগত আগ্রহে বাংলায় কয়েকটি রায় লিখলেও এর সংখ্যা খুবই নগণ্য।

সংবিধানের এ বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইনও প্রণয়ন করা হয়। আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। যদি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন, তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।

এআইএম/ একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর