রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

আইনের ডিগ্রি নেই লাইসেন্সও নেই, তাও বড় আইনজীবী!

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ১১ জুন ২০২৪, ০৯:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

আইনের ডিগ্রি নেই লাইসেন্সও নেই, তাও বড় আইনজীবী!

তাদেরকে সহজে বোঝার উপায় নেই যে তারা আইনজীবী না। চাল-চলন, কথাবার্তা লেনদেনসহ মক্কেল ম্যানেজ করতে তারা বাকপটু। আইন নয়, কথায় ভুলিয়ে রাখেন ভুক্তভোগীদের। এমনকি প্রকৃত আইনজীবীদেরকেও মাঝে-মধ্যে উপদেশ দিয়ে থাকেন এরা। তারা বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তিকরণ পরীক্ষায় পাস না করলেও বেশভূষায় পাকা আইনজীবীর মতো। দেশের বিচারিক আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতেও তাদের সরব উপস্থিতি। আসলে এরা ভুয়া আইনজীবী। মাঝেমধ্যে ধরাও পড়ছেন। কাউকে দেওয়া হচ্ছে পুলিশে। কেউ আবার রক্ষা পান মুচলেকা দিয়ে।

এমন আইনজীবী পরিচয় দেওয়া লোকদের ‘টাউট’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এদের হাত থেকে বিচারপ্রার্থীদের রক্ষায় গঠন করা হয়েছে আলাদা কমিটি।


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি সেলিম উদ্দিন নামের একজন ধরা পড়েন ঢাকা আইনজীবী সমিতির (ঢাকা বার) টাউট উচ্ছেদ কমিটির হাতে।

জানা গেছে, কিছুদিন আগে আদালতের এজলাসে দাঁড়িয়ে অন্য এক আইনজীবীকে ডিকটেশন দিচ্ছেলেন একজন। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনেক জ্ঞানী। কিন্তু দেখা গেলো তার আইনজীবী সনদই নেই। আর সনদ ছাড়াই ১৭ বছর আইনজীবী পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। পরনেও আইনজীবীর পোশাক। সাদা জামার ওপর কালো কোট। গলায় কলার ব্যান্ড (গলাবন্ধনী)। নিজের নামে ব্যবহার করেন সিলও। টাউট উচ্ছেদ কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে ধরা পড়লেন বিচারপ্রত্যাশী ও আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করে আসা সেলিম উদ্দিন নামের ওই ব্যক্তি। পরে তাকে তুলে দেওয়া হয় শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে।

দিন দিন আদালত প্রাঙ্গণে বাড়ছে এ ধরনের টাউটের সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত— জানতে চাইলে হিউম্যান রাইডস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আইনজীবী সমিতিগুলো যদি টাউটদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালায়, নিয়মিত মনিটরিং করে, তাহলে এটি রোধ করা সম্ভব। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্রিটিশ আমল থেকেই একটা আইন আছে। সে আইনে প্রদত্ত সাজা বর্তমান সময়ের তুলনায় খুবই নগণ্য। তখনকার প্রেক্ষাপট আর এই সময়ের প্রেক্ষাপট কিন্তু এক না। আমি মনে করি আইনজীবী পরিচয় দিয়ে যারা প্রতারণা করে তাদের বিষয়ে সাজা-শাস্তি বাড়ানো উচিত।

মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, ঢাকা বার, সুপ্রিম কোর্ট বারসহ দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলের বারগুলোতে মাঝেমধেই ভুয়া আইনজীবী গ্রেফতার করা হয়। মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া বা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এতে করে কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। বরং সমস্যা বাড়ছে। এজন্য এ বিষয়ে সবার সচেতন হওয়া জরুরি।


বিজ্ঞাপন


আটক ভুয়া আইনজীবী সেলিম উদ্দিনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (সুপ্রিম কোর্ট বার) কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সম্পাদক ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব ঢাকা মেইলকে বলেন, দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট মূল ভবনের ২৩ নম্বর আদালতে (বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ) মামলার শুনানিকালে একজন আইনজীবীর পিছন থেকে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিচ্ছিলেন সেলিম উদ্দিন। এ সময় কয়েকজন আইনজীবীর সন্দেহ হয়।

এরপর আদালতের ভেতরেই তাকে চ্যালেঞ্জ করেন অপর আইনজীবীরা। একপর্যায়ে তাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর নিয়ে যাওয়া হয় সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের দোতলায় সমিতির কক্ষে। সেখানে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর ওই ব্যক্তির কাছ থেকে তার নামে থাকা সিল ও জ্যেষ্ঠ কয়েকজন আইনজীবীর অন্তত ৩০টি ভিজিটিং কার্ড উদ্ধার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম উদ্দিন দাবি করেন, তিনি ২০০৭ সালে আইনে স্নাতক করেছেন। তবে বার কাউন্সিলের কোনো সনদ নেই। তিনি ঢাকার আদালতে এবং ২০১৮ সাল থেকে হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চে যাওয়া আসা করছেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিচারপ্রত্যাশীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তাদের মামলায় জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার পরিচিত আইনজীবীদের কাছে নিয়ে যেতেন। তবে এখন পর্যন্ত বার কাউন্সিলের কোনো পরীক্ষায় তিনি অংশ নেননি। শুধু রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন।

এদিকে গত ২৩ এপ্রিল আইনজীবী পরিচয় প্রদানকারী লিটন নামের এক ‘টাউট’কে ঢাকার আদালত এলাকার পারজোয়ার বিল্ডিংয়ের চেম্বার থেকে আটক করা হয়। ঢাকা বারে ক্লার্কের কাজ করতেন লিটন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রতারণার অভিযোগে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এ ঘটনায় ঢাকা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। আইনজীবী পরিচয় দিয়ে ২০১৪ সাল থেকে ঢাকা কোর্টে নিয়মিত প্র্যাকটিস করে আসছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিছেন প্রতারক লিটন।

ঢাকা বারের ‘টাউট উচ্ছেদ কমিটি’র সাবেক সদস্য সচিব ও সহ-সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবু জানান, আটক ব্যক্তি বার কাউন্সিলের আইনজীবী সনদধারী নন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণা করছিলেন।

আইনের ডিগ্রি না নিয়েও বড় আইনজীবী!

লাইসেন্স দূরের কথা আইনের কোনো ডিগ্রি না থাকলেও আইনজীবী পরিচয়ে আদালত চত্বরে ঘুরছেন কেউ কেউ।

২০১৭ সালে আইনজীবী পরিচয়ে বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে পারভীন নামের এক নারীকে আটক করা হয়। পরে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয় ঢাকা আইনজীবী সমিতির (ঢাকা বার) টাউট উচ্ছেদ কমিটি।

তখনকার ঢাকা বারের নির্বাহী কমিটির সদস্য ইব্রাহিম খলিল জানান, আটক নারীর আইনবিষয়ক কোনো সনদ নেই। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেই আইনজীবী পরিচয় দিয়ে মামলা পরিচালনা করতেন। তিনি আইনজীবীদের মতো পোশাকও পরতেন। ওই নারী ঢাকার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা। ঢাকা বারের সিদ্ধান্তে নারী বিবেচনায় তাকে ছয় হাজার টাকা মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে আবার আদালত প্রাঙ্গণে দেখা গেলে কারাগারে পাঠানো হবে।

কারাগারে ভুয়া আইনজীবী

২০১১ সালে আইনজীবীর পরিচয় দিয়ে মক্কেলের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে টাকা নেওয়ার মামলায় এক ব্যক্তিকে জেল হাজতে পাঠান আদালত। তার নাম আব্দুল বারী।

জানা যায়, ঢাকার ষষ্ঠ জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন দেওয়ানি নং ২৫১/০৪ মামলার রায় পেশকার, স্টেনো ও পিয়নদের সহায়তায় প্রভাবিত করতে মক্কেলের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে প্রতারক আবদুল বারী। বাদী একেএম আজাদ রশিদ তাকে ৭০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু একাধিক তারিখ পার হলেও মামলার অগ্রগতি না হওয়ায় এ মামলায় বাদী অন্য এক আইনজীবী নিয়োগ করলে প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ পায়।

এ ঘটনায় ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাদী কোতয়ালী থানায় একটি প্রতারণার মামলা করেন। মামলায় আইনজীবী পরিচয়দানকারী আব্দুল বারী, ৬ষ্ঠ যুগ্ম জেলা জজ আদালতে পেশকার ফজলুল হক সরকার, স্টেনোগ্রাফার মুসাফিকুল আলম, পিয়ন আবুল কালাম ও জনৈক মোতালেবকে আসামি করা হয়।

মোতালেব গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর, পেশকার ফজলুল হক সরকার, স্টেনোগ্রাফার মুসাফিকুল আলম ও পিয়ন আবুল কালাম ২১ সেপ্টেম্বর ও আব্দুল বারী ২৬ সেপ্টেম্বর আদালত হতে জামিন নেন।

আব্দুল বারীর বিষয়ে জানতে বাদী পক্ষের আইনজীবী ঢাকা বারে আবেদন করলে ঢাকা বারের সহ-সম্পাদক আমিনুর রহমান খান লিখিতভাবে জানান, এ নামে কোনো আইনজীবী ঢাকা বারের সদস্য নন। আদালত ওইদিনই তার জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে কোতয়ালী থানা পুলিশ মঙ্গলবার তাকে গ্রেপ্তার করে।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণাকারী মোসলেম উদ্দিন চৌধুরী সোহাগ নামে এক টাউটকে আটক করে থানায় দিয়েছে আইনজীবী সমিতি।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির ভবনের সামনে থেকে মোসাম্মৎ মৌ নামের এক ভুয়া আইনজীবীকে আটক করে টাউট উচ্ছেদ আন্দোলন কমিটি। তিনি সাত বছর ধরে নিয়মিত আদালতে প্র্যাকটিস করছেন বলে জানা গেছে।

এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণাকারী এক নারীকে আটক করে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। তার নাম তানজিমা তাসকিন আদুরি। বাড়ি রাজশাহী।

এসব প্রতারককে নির্মূলের দাবিতে মাঝেমধ্যেই মানববন্ধন করে টাউট দালাল নির্মূল আন্দোলন। এই কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুঁইয়া।

তিনি জানান, আইনজীবী পরিচয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই প্রতারকরা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন প্রতারককে ধরে থানায় সোপর্দ করেছেন টাউট দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেতারা। এদেরকে সুপ্রিম কোর্ট থেকে নির্মূল করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি। 

সম্প্রতি ধরা পড়া নারী আইনজীবীর বিষয়ে তিনি বলেন, ওই নারী নিজেকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন। বিচারপ্রার্থীদের বিভ্রান্ত করে আইন পেশার মানহানি করেছেন। 

এআইএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর