শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

গরমে কালো কোট-গাউনের বাধ্যবাধকতা শিথিল চান আইনজীবীরা

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ২২ মে ২০২৪, ১১:৩৩ এএম

শেয়ার করুন:

গরমে কালো কোট-গাউনের বাধ্যবাধকতা শিথিল চান আইনজীবীরা

গরমের মধ্যেও কোট-গাউন পরার বাধ্যবাধকতা নিয়ে অনেক আগে থেকেই আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। তীব্র গরমে কালো পোশাক পরে কাজ করা আইনজীবীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠে। এজন্য আইনজীবী ও বিচারকদের জন্য গ্রীষ্ম ও শীতকালীন আলাদা ‘ড্রেস কোড‘ নির্ধারণের দাবি জানান অনেক আইনজীবী। বিশেষ করে গত বছর ‘হিট স্ট্রোকে’ আদালত চত্বরে একজনের মৃত্যুর পর তা আরও জোরালো হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের কালো কোট ও গাউন পরার বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই দিয়েছিল। তবে শীত পড়ার পর ফের কালো গাউন ও কোট পরা শুরু হয়। এবারও অতি গরম বিবেচনায় কিছু সময়ের জন্য পোশাকে শিথিলতা এনেছিল বিচার বিভাগ। পরে সেটি প্রত্যাহার করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। কিন্তু এখনো দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ বিরাজ করায় এমন সিদ্ধান্তে আইনজীবীদের অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন যেহেতু গরম আরও কিছুদিন থাকবে তাই পোশাকে শিথিলতা বহাল রাখা দরকার ছিল।

সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের এজলাস কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা থাকলেও নিম্ন আদালতে এসি নেই বললেই চলে। ফলে গরমে এই অঙ্গনের এজলাসে আইনজীবীদের অনেক কষ্ট করতে হয়। বিশেষ করে ঢাকা জজ আদালতে এর প্রভাবটা অনেকাংশেই বেশি। কারণ সারা বাংলাদেশের আইনজীবীর প্রায় অর্ধেক এখানে। ৩২ হাজার আইনজীবী সমিতির সদস্য। শুধু ঢাকা নয় দেশের আরও অনেক জায়গার আইনজীবী নেতারাও গরমে পোশাকের বাধ্যবাধকতা শিথিল চান।


বিজ্ঞাপন


ঢাকার আদালতের চিত্র তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার ঢাকা মেইলকে বলেন, অধস্তন আদালতগুলো শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত নয়। যার ফলে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে কোর্ট-গাউন পরে শুনানিতে অংশ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিচারক, আইনজীবীদের পোশাক পরিধানের বিষয়টি শিথিল করা হোক। এমনটা প্রত্যাশা করি। মাননীয় প্রধান বিচারপতি বিষয়টিকে সময়োপযোগী মনে করে নির্দেশনা দেবেন বলে আমার বিশ্বাস। সুপ্রিম কোর্টের পাশাপাশি ঢাকা জজ আদালতে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন প্রশান্ত কুমার কর্মকার।

ইতোমধ্যে ঢাকার আদালত কোর্টের সব এজলাস কক্ষে এসি স্থাপনে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঢাকার জেলা প্রশাসককে এ নোটিশের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে। সংবিধানের মৌলিক অধিকার ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী ও বিচারকদের জীবনের সুরক্ষায় এই আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের শরীরও গরম হয়ে যায়। এর ফলে রক্তনালীগুলো খুলে যায়। এর জের ধরে রক্তচাপ কমে যায়, যে কারণে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা হৃদপিণ্ডের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এসব কারণে মৃদু কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে ত্বকে ফুসকুড়ি পড়া, চুলকানি এবং পা ফুলে যাওয়া, যা রক্তনালী উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে হয়ে থাকে। এছাড়া প্রচুর ঘাম হওয়ার কারণে শরীরে তরল পদার্থ ও লবণের পরিমাণ কমে যায়। গুরুতর ক্ষেত্রে দেহে এ দুইটি জিনিসের মধ্যে যে ভারসাম্য আছে, তাতেও পরিবর্তন ঘটে। এসব কিছু একসঙ্গে মিলিয়ে গরমে শরীর পরিশ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। এর লক্ষণগুলো হচ্ছে, মাথা চক্কর দেওয়া, বমি বমি ভাব, নিস্তেজ হয়ে পড়া, মূর্ছা যাওয়া, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়া, পেশি সংকুচিত হওয়া, মাথা ব্যথা, প্রচণ্ড ঘাম হওয়া ও ক্লান্তি। আর রক্তচাপ খুব বেশি কমে গেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এসব কারণে ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ (সিডিসি) মানুষকে বিভিন্ন গাইডলাইন দেওয়ার পাশাপাশি যথাসম্ভব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


নোটিশে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে তাপপ্রবাহে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী ও বিচারকরা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। ঢাকা জজ কোর্টের কক্ষগুলোর আয়তন খুবই ছোট। বিপুল সংখ্যক বিচারপ্রার্থীর ভিড়ে কোর্টের অধিকাংশ এজলাস কক্ষ গিজগিজ করে। একদিকে তীব্র তাপপ্রবাহ, অপরদিকে ছোট আয়তনের এজলাস কক্ষ্যে বিপুল সংখ্যক বিচার প্রার্থীদের ভিড়। সবমিলিয়ে আইনজীবী ও বিচারকরা অত্যন্ত কষ্টে তাদের আইনি দায়িত্ব পালন করেন। এমতাবস্থায় এই তীব্র তাপপ্রবাহে ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী ও বিচারকদের জীবন চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এজন্য ঢাকা জজ কোর্টের সব এজলাস কক্ষে অনতিবিলম্বে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) স্থাপন করা অত্যাবশ্যক।

এদিকে ঢাকার বাইরেও অতি গরমের প্রভাব পড়েছে। গরম না কমা পর্যন্ত পোশাকের শিথিলতা চান সিরাজগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদুর রহমান মাসুদ। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আমাদের কোর্টের এজলাসগুলোতে এসির ব্যবস্থা নেই। অনেকগুলো এজলাসের মধ্যে মাত্র দুটি এজলাসে এসি আছে। বাকিগুলোকে ফ্যানের ব্যবস্থা। আগামী ঈদুল আজহা পর্যন্ত আইনজীবীদের জন্য ‘কোট গাউন‘ পড়ার ক্ষেত্রে শিথিলতা থাকলে ভালো হতো। কারণ এখনো গরম কমে নাই। এতো গরমের মধ্যে ‘কোট গাউন’ পড়ে আদালতে মামলা শুনানি করা অনেক কষ্টকর।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বাহাউদ্দিন আল ইমরান ঢাকা ঢাকা মেইলকে বলেন, অতিরিক্ত তাপদাহের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। এ অসহনীয় গরমের মধ্যে আইনজীবীদের কালো পোশাক শরীরে তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এটা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। বৃটিশ আমলের সেই ড্রেসকোড থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ এখনো বেরিয়ে না আসা পারা দুঃখজনক ব্যাপার। কোর্ট প্রশাসনের উচিত হবে জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে দেশে মৌসুমভেদে আইনজীবীদের পোশাক নির্ধারণ করা। এতে অতি গরমের মাঝেও আইনজীবীরা গরমের হাত থেকে সুরিক্ষিত থাকতে পারবে।

ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মো. সাইফুল ইসলাম সাইফ ঢাকা মেইলকে বলেন, সব পেশার একটি ড্রেস আছে। আইনজীবীদের ড্রেস থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে অতিগরমে এই ড্রেসের শিথিল করা উচিত বলে আমি মনে করি।

তীব্র গরমে গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অধস্তন আদালতে মামলার শুনানিকালে বিচারক ও আইনজীবীদের পরিধেয় পোশাকের বিষয়টি শিথিল করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নির্দেশনায়। প্রায় দেড় মাস পর আবারও বিচারক-আইনজীবীরা কালো কোট ও কালো গাউন পড়ে শুনানি করবেন। গত ১৯ মে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, অধস্তন দেওয়ানি, ফৌজদারি আদালত/ট্রাইব্যুনাল সমূহের বিজ্ঞ বিচারক ও আইনজীবীবৃন্দের মামলা পরিচালনাকালীন পরিধেয়  পোশাক সংক্রান্ত অত্র কোর্টের (সুপ্রিম কোর্ট) বিগত ৪ এপ্রিলের বিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা স্থগিত করা হলো। এমতাবস্থায় বিচারক ও আইনজীবীরা মামলা পরিচালনার সময় সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডার, ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডার এর বিধান অনুসরণপূর্বক  পোশাক পরিধান করার নির্দেশ প্রদান করা হলো।

গত ৪ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তক্রমে সুপ্রিম কোর্টের একটি বিজ্ঞপ্তিতে অধস্তন আদালতে বিচারক-আইনজীবীদের কালো কোট ও গাউন পরিধানের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করে বলা হয়, সব অধস্তন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত-ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং আইনজীবীরা ক্ষেত্রমত সাদা ফুলশার্ট বা সাদা শাড়ি/সালোয়ার কামিজ ও সাদা নেক ব্যান্ড/কালো টাই পরিধান করবেন। এক্ষেত্রে কালো কোট এবং গাউন পরিধান করার আবশ্যকতা নেই।

এরপর ২০ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পৃথক একটি বিজ্ঞপ্তিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে মামলার শুনানিকালে আইনজীবীদের কালো গাউন পড়ার আবশ্যকতা শিথিল করা হয়।

এআইএম/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর