শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে ‘মানসিকতা’ই গুরুত্বপূর্ণ

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ১৫ মে ২০২৪, ০৯:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে ‘মানসিকতা’ই গুরুত্বপূর্ণ

দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ধারা ৮৯(১) এ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা আছে। দেওয়ানি মামলায় আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (অলটারনেটিভ ডিসপুট রেজল্যুশন) বা এডিআর মামলা পূর্ব ও পরবর্তী বিরোধ নিষ্পত্তিতে উত্তম ও সহজ পদ্ধতি। কিন্তু এডিআর নিয়ে ধারণা ও প্রচারের ঘাটতি এবং ছাড় না দেওয়ার মানসিকতাসহ নানা কারণে ‘বিকল্প’ হয়ে উঠতে পারছে না বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা।

বাংলাদেশে এ আইনটির প্রায় দুই যুগ পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা। তবে শুরুতে ভালো ফল না দিলেও ধীরে ধীরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা উচিত। তাহলে আদালতের ঘাড়ে চাপ কমবে। মানুষও রেহাই পাবে সহজে। আবার কেউ কেউ বলছেন, এতে করে হয়রানি কমছে বিচার প্রার্থীদের।

আদালতের মামলা প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, এডিআর-এর মাধ্যমে দুটি পক্ষই বিজয়ী হয় বা পরাজিত হয়। কিন্তু মামলার ক্ষেত্রে এক পক্ষ জয়লাভ করে, আর অন্য পক্ষ হেরে যায়। মামলায় যুক্তি-তর্ক দিয়ে আইনজীবী বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। অন্যদিকে এডিআর-এ দুটি পক্ষই মন খুলে কথা বলতে পারে। তাই এই প্রক্রিয়াটি বিরোধ নিষ্পত্তিতে দুই পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে ড. মিজানুর রহমান বলেন, আদালতে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে শুধু ‘আমি’ ব্যবহার হয়। কিন্তু এডিআর-এ ব্যবহৃত হয় ‘আমরা’। অর্থাৎ পুরো একটি যৌথ বিষয়। এখানে সামাজিক সব সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত অভিযোগ থেকে ক্ষমাও পাওয়া যায়। মামলার ক্ষেত্রে শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ করে আপিলের সুযোগ থাকে। কিন্তু এডিআর-এ আপিলের সুযোগ নেই। তাই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত সবাইকে মেনে নিতে হয়।

দিনদিন বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন হিউম্যান রাইডস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের দেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইন অনেক পুরানো। বিদেশিরা কিন্তু বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে খুবই সচেতন। বিষয়টি তারা খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। ওখানে আপনি যদি একটা মামলা অহেতুক নিয়ে যান এবং আপনি যদি হেরে যান কোর্টে আপনাকে টোটাল খরচ দিতে হবে। ওই ধরনের প্রবিশন আমাদের দেশে নাই। যার কারণে আমাদের দেশে ২০ থেকে ২৫ বছর আগে বিকল্প বিরোধ পদ্ধতি চালু হলেও সেটি কাজে লাগছে না। এজন্য প্রশ্ন আসছে যে বাংলাদেশের মানুষ নিজেরা নিজেরা বিরোধ নিষ্পত্তি করে ফেলবে— এজন্য সঠিক মানসিকতা দরকার। সেই মানসিকতা আমাদের অনুপস্থিত বলে মনে হয়।


বিজ্ঞাপন


তিনি বলেন, বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা সেখানে যাই না। আমরা সরাসরি মামলা-মোকাদ্দমার মধ্যে চলে আসি। মামলা-মোকাদ্দমার মধ্যে চলে আসলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে একজন কিন্তু হারবে। এখানে হার-জিত তো থাকবেই চূড়ান্ত পর্যায়ে। আপিল বিভাগে থেকে যখন চূড়ান্ত রায় আসে তখন একজন হারে আরেকজন জেতে। এডিআর বা আপস নিষ্পত্তির মাধমে যদি আমরা বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারি, তাহলে এটা কিন্তু সবার জন্যই ভালো। বিচার বিভাগ থেকে চাপ কমে যাবে। আমরা চাপ থেকে বাঁচতে পারবো। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক অর্থ খরচ কম হবে। আপস নিষ্পত্তির বিষয়ে আমাদের মানসিকতার অভাব রয়েছে। তবে আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতির ব্যবহার। মামলা শুরুর আগেই যদি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিরোধ সমঝোতা করা যায় তাহলে সেটা অনেক ভালো।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মূল লক্ষ্য মামলায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা। আমাদের দেশে তিন ধরনের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা রয়েছে— (১) আলাপ-আলোচনা বা নেগোসিয়েশন: এ পদ্ধতিতে পক্ষগণ কারো সাহায্য ছাড়াই নিজেরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হয়।

(২) মধ্যস্থতা বা মিডিয়েশন: এ পদ্ধতিতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত হন এবং কোনো ধরনের জোরারোপ বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ব্যতীত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষকে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন।

(৩) সালিশ বা আরবিট্রেশন: এ প্রক্রিয়াটির ধরন মধ্যস্থতার মতো হলেও কিছুটা নিয়মনিষ্ঠভাবে সম্পাদিত হয়। এখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আদালত বা কোনো আরবিট্রেশন বডি থাকে, যেখানে পক্ষগণকে সমঝোতায় এনে সমাধান প্রণয়ন করা হয়।

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির অগ্রযাত্রা

সালিশ, গ্রাম আদালত এবং মুসলিম পারিবারিক আইনে আগেই এ বিধানের প্রচলন ছিল। ১৯৪০ সালে আরবিট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯৬৯ সালে শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এবং ১৯৮৫ সালে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রথম এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫-তে মামলার বিচারের শুনানিপূর্ব (প্রি-কেস) পর্যায়ে আদালতের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আপস বা সমঝোতার মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার, এমনকি বিচার শেষ হওয়ার পরও রায় প্রদানের পূর্বে (পোস্ট-কেস) উক্ত প্রক্রিয়ায় মীমাংসাকরণের বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে।

এ অধ্যাদেশের ১০ ও ১৩ নম্বর ধারায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উল্লেখ আছে। এই নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মধ্যস্থতা ও সালিশের মাধ্যমে দেওয়ানি মোকদ্দমা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধনী) ২০০৩ বলে এই আইনে ৮৯(ক) ও ৮৯(খ) দুটি ধারা সংযোজিত হয়েছে, যার ফলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এরই সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এ ধারা ২১-২২-এর মাধ্যমে ফয়সালামূলক বিধান ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়াও শ্রমিক আইন, ২০০৬-এর ধারা-২১০ (১, ২, ৪, ৬, ১৬)-এ এই বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ২০০০ সালের আইনগত সহায়তা আইনে ২০১৩ সালে ২১(ক) ধারা সংযোজন করে মধ্যস্থতার বিধান আনা হয়। সর্বোপরি ২০১৫ সালে আইনগত পরামর্শ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র নীতি প্রণীত হয়, যার মাধ্যমে এর গুরুত্ব ফুটে ওঠে।

এআইএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর