রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় সুপ্রিম কোর্টে আটকে যেসব চাঞ্চল্যকর মামলা

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ০১ মে ২০২৪, ০৭:৩৯ পিএম

শেয়ার করুন:

চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় সুপ্রিম কোর্টে আটকে যেসব চাঞ্চল্যকর মামলা

নিম্ন আদালতের ধাপ পার হলেও চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার চূড়ান্ত রায় আটকে আছে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে। অনেক মামলা শুনানি করে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া তো দুরের কথা, পেপারবুকই প্রস্তুত হয়নি। এই তালিকায় আছে সাভারের রানা প্লাজা ধস মামলা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, প্রকাশক দ্বীপন হত্যা, ফেনীর নুসরাত হত্যা, সিলেটের রাজন হত্যা, অভিজিৎ রায় হত্যা, খুলনার রাকিব হত্যা, বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা, একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, রমনার বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ মামলাসহ অনেক মামলা।

এসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বাড়ছে মামলা জট। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, উচ্চ আদালতে উল্লেখযোগ্য হারে মামলা নিষ্পত্তি হলেও জট কমছে না। এর অন্যতম কারণ পুরোনো ও চাঞ্চল্যকর মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া। পাশাপাশি এসব মামলায় ন্যায়বিচার চেয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন অনেকেই। এমন বাস্তবতায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে এসব মামলার নিষ্পত্তির উদ্যোগের ওপর জোর দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।


বিজ্ঞাপন


রাষ্ট্রপক্ষের একাধিক আইনজীবী প্রায় অভিন্ন সুরে জানান, চাঞ্চল্যকর কিংবা আলোচিত— যে মামলাই হোক তা হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে শুনানির পর্যায়ে আসে ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী। তবে যেসব মামলা বিশেষ অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো, সেগুলো দ্রুত শুনানির জন্য রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ উদ্যোগী হয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতকে অবহিত করতে পারেন। যদি উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে উচ্চ আদালত প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার শুনানি ও তা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে পারে।

সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের বিচারক সংখ্যা কম। কোর্টের সংখ্যাও কম। তারপরও এখতিয়ার সম্পন্ন কোর্টে এসব মামলা যদি মোশন ও শুনানির জন্য সপ্তাহে অন্তত একদিন রাখা হতো, তাহলে চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো আটকে থাকতো না।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের কমপ্লেইন্ট অ্যান্ড ভিজিলেন্স কমিটির চেয়ারম্যান সাঈদ আহমেদ রাজা ঢাকা মেইলকে বলেন, চাঞ্চল্যকর এই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। এগুলো আমরা নিষ্পত্তি করতে পারছি না। এর দায় আমি মনে করি সারাদেশের ৭০ হাজার আইনজীবীর। দল-মত নির্বিশেষে সবার দায়িত্ব রয়েছে এসব মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার।

তিনি বলেন, আগে আমরা দেখতাম আলোচিত মামলাগুলো নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস গুরুত্ব দিত বেশি। এখন সেটা দেখা যাচ্ছে না। চাঞ্চল্যকর এ মামলাগুলোর বিচার দেখতে সারাদেশের মানুষ তাকিয়ে আছেন। কাজেই আমি মনে করি এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার প্রয়োজন।


বিজ্ঞাপন


এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভুঁইয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, এসব চাঞ্চল্যকর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই। যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ভিকটিমের পরিবার, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গোনা আসামিরা।

রাজা বলেন, আমার মতে এসব মামলায় দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য প্রধান বিচারপতি বরাবর আবেদন করা উচিত। মামলার বাদীপক্ষ বা আসামিপক্ষে এসব মামলা শুনানি করাতে রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদন করলে তার একটি সুরাহা আসবে।

এই আইনজীবী আরও বলেন, মাঝে মধ্যে আদালতের কার্যতালিকায় দেখা যায় কোনো কোনো মামলার পাশে লেখা আছে সেন্ট বাই চিফ জাস্টিস। অতিরিক্ত গুরেুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে প্রধান বিচারপতি এগুলো পাঠিয়ে দেন।

নারায়ণগঞ্জে সাত খুন

হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট এক রায়ে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা সাবেক কাউন্সিলর নুর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর বরখাস্ত কর্মকর্তা তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী আসামিরা সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন। তবে অদ্যাবধি এ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির রায় আসেনি।

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলা

পুরান ঢাকায় দর্জি বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দুজনের মৃত্যুদণ্ড ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট হাইকোর্ট তার রায়ে বহাল রাখে, চারজনকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজনকে খালাস দেয়। এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৩ জনের মধ্যে যে দুজন আপিল করেন তারাও খালাস পান। এরপর ওই বছরের ৩১ অক্টোবর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে দণ্ডপ্রাপ্তরা আপিল করেন। এখনও সে আপিল নিষ্পত্তি হয়নি।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনার ১৪ বছরের বেশি সময় পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এক রায়ে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিস্ফোরক মামলায় ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) নথি ওই বছরের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে পাঠানো হয়। রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডপ্রাপ্তরা (পলাতক ছাড়া) আপিল ও জেল আপিল করেন। সাজাপ্রাপ্ত ৪৪ আসামির আপিল বিচারাধীন রয়েছে।

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা

চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) জেটি ঘাট থেকে ১০ ট্রাক অস্ত্র চালানের ঘটনায় চোরাচালান ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বিচারিক আদালত ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এরপর মামলাটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে বিচারের জন্য উঠলে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এ মামলায় চট্টগ্রামের বিচারিক আদালতে মামলাসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে শুনানি নিয়েছিলেন জানিয়ে এটি শুনতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নতুন বেঞ্চে এর শুনানি শুরু হয়নি।

রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলা

২০০১ সালে রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে ১০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলায় শীর্ষ জঙ্গি মুফতি হান্নানসহ (ইতিমধ্যে অন্য মামলায় দণ্ড কার্যকর) আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রুহুল আমিন এ রায় দেন। ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসার পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে পেপারবুক প্রস্তুত করে ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়। কিন্তু এরপর বেঞ্চ বদল হলে আপিল শুনানি একপ্রকার থমকে আছে।

উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টে মোট বিচারপতি রয়েছেন ৯৩ জন। এরমধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে ৮৫ এবং আপিল বিভাগে বিচারপতি রয়েছেন ৮ জন। মামলার তুলনায় বিচারপতির সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় অনেক মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করতে সময় লেগে যাচ্ছে।

এআইএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর