শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ঢাকা

আইনাঙ্গনে চ্যালেঞ্জ উত্তরণে একঝাঁক তরুণ আইনজীবীর ভাবনা

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৩ পিএম

শেয়ার করুন:

তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে চান তরুণ আইনজীবীরা

অসহায়, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমাজ সংস্কারে অবদান রাখেন আইনজীবীরা। এজন্য তাদেরকে বলা হয় সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তবে সমাজ সংস্কারের অবদান স্বল্প সময়ের মধ্যে রাখা সম্ভব না। এজন্য প্রয়োজন নানামুখী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ। গুরুবিদ্যা এ প্রফেশনের শুরুতে কাঠখড় পোড়াতে হয় দিন-রাত। অক্লান্ত পরিশ্রম, মানসিক শক্তি আর দঢ় প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। আইনজীবী হিসেবে সমাজের নানা অসঙ্গতির সমাধান করে সফলতা পেতে চান সুপ্রিম কোর্টের স্বপ্নবাজ একঝাঁক তরুণ ব্যারিস্টার ও আইনজীবী।

বিচারবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরিতে প্রতিনিয়ত হাজারো স্বপ্ন দেখছেন তারা। আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করতে ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অনুমতি পেয়েছেন তারা। আইন প্রফেশনের বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতে কী করতে চান সেই বিষয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের এই নবীনরা।


বিজ্ঞাপন


ব্যারিস্টার রাগীব কবির

স্বপ্নবাজ তরুণ ব্যারিস্টার রাগীব কবির বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের ভূমিকা অনন্য ও অপরিসীম। ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং গতিশীল করে তোলা ছাড়াও আইনজীবীরা আদালতকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় সহায়তা করেন। যদিও তরুণ আইনজীবীদের কর্মজীবনের প্রারম্ভে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ ও জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এই পরিস্থিতিগুলো তাদের পেশাগত দক্ষতা, জ্ঞান এবং আত্মবিশ্বাস বিকাশে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আমি একজন তরুণ আইনজীবী হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সত্য-ন্যায়ের প্রতি অনুগত থেকে আইন পেশার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান বজায় রাখব। অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার মাধ্যমে কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জন নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার ও বিচার ব্যবস্থার উন্নতিতেও গভীর অবদান রাখা সম্ভব।

আমি মনে করি তরুণ আইনজীবীদের পেশাগত মানোন্নয়নের প্রয়াসে প্রফেশনাল ট্রেনিং, প্রযুক্তির সঙ্গে একাত্মতা সাধন, আর্থিক স্থিতিশীলতা, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করা অত্যন্ত জরুরি। বার এবং বেঞ্চের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনায় এই ক্ষেত্রগুলোতে আরও গভীরতর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। তরুণ আইনজীবীদের জন্য নিয়মিত এবং উন্নত প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম আয়োজন, প্রযুক্তি ব্যবহারে বিশেষ প্রশিক্ষণ, আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বেতন ও ফি’র স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ, মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং সার্ভিস সুবিধা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তরুণ আইনজীবীদের পেশাগত দক্ষতা এবং সামগ্রিক আইন পেশার মর্যাদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব।

অ্যাডভোকেট মো. মনিরুল ইসলাম মিয়া


বিজ্ঞাপন


রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো উল্লেখ করে আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মনিরুল ইসলাম মিয়া বলেন, সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত আমাদের রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যগুলো সাধারণ নাগরিকের জীবনের মৌলিক অংশ। এ প্রধান উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল রেখে ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আইনের পরিপূর্ণ অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আইনজীবীরা social engineer হিসেবে কাজ করে থাকেন। আমি মনে করি, নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নতুন আইনের সৃষ্টি এবং পুরাতন আইনের পরিমার্জন প্রয়োজন। এই আইন পরিবর্তনে মানুষের অধিকার এবং মর্যাদা নিশ্চিত হবে।

এছাড়া আইনাঙ্গনে তরুণ আইনজীবীদের তথ্য-প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণ আইনজীবীরা বিচারপ্রার্থীদের জন্য সহজ ও দ্রুততম সময়ে বিচারপ্রাপ্তিতে ভূমিকা রাখতে পারবেন। আধুনিক সময়ে তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিকদের বিচার প্রদানের প্রক্রিয়া আরও সহজ ও উন্নত করা হলে সহজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।

আইন পেশায় নাগরিক সেবা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে দেশ ও সমাজের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

ব্যারিস্টার উম্মে আইমান জেনিব

ওকালতিকে বলা হয় নোবেল প্রফেশন। আর আইনজীবীর উপাধি লার্নেড। এমন বাস্তবতায় একজন আইনজীবীর দায়িত্ব-কর্তব্যও অনেক বেশি। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার উম্মে আইমান জেনিব বলেন, একজন আইনজীবী মূলত আইনের তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তির বা সংস্থার আইনি সমস্যার সমাধানের কাজ করে থাকেন। একমাত্র পেশা যেখানে ‘বিজ্ঞ আইনজীবী’ (Learned Advocate) সম্বোধন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সংবিধানে বর্ণিত যেকোনো মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী প্রথমেই একজন আইনজীবীর নিকট যান। তাই দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারের অন্যতম অনুঘটক হচ্ছেন আইনজীবীরা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলে, দেশের কল্যাণমুখী রাজনীতিতে আইনজীবীদের ভূমিকা অনেক। তরুণ আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি আইনজীবীর অন্যতম দায়িত্ব হলো তার মক্কেলের সর্বোত্তম স্বার্থে এবং আইন অনুযায়ী কাজ করা।

ব্যারিস্টার আরিফ চৌধুরী

আইন পেশা একটি সেবামূলক পেশা উল্লেখ করে ব্যারিস্টার আরিফ চৌধুরী বলেন, আইন পেশা একটি সেবামূলক পেশা। আমি মনে করি একজন আইনজীবী যদি আইন পেশাকে মনে প্রাণে ধারণ-শ্রদ্ধা করে তাহলে এই পেশায় থেকে সমাজে প্রকৃত অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কারণ, সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীর ভূমিকা অপরিসীম।

Lord Denning said: “The law is a powerful tool for society change. It can break down barriers and promote equality and justice.”

সুতরাং, আইনজীবীদের একটাই ব্রত থাকা দরকার যে, সমাজ সংস্কারে ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যে কাজ করে যাওয়া এবং আমি সেই ব্রত নিয়েই আইন পেশা চালিয়ে যাচ্ছি।

অ্যাডভোকেট মো. রোকনুজজামান

আইনজীবীদেরকে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়ে থাকে। কারণ তারা সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি কাছ থেকে দেখতে পারেন। তারা এসব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসে আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মো. রোকনুজজামান বলেন, আইনজীবীরা সমাজের অসঙ্গতিগুলো যত কাছ থেকে দেখতে পান তা আর কারও পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। সুতরাং সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর করার জন্য আইনজীবীরা যত সহজে প্রকৃত সমস্যাগুলো উপলব্ধি করতে পারবে তা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আর এজন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়, সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলে, দেশের কল্যাণমুখী রাজনীতিতে আইনজীবীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

তরুণ আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি আইনজীবীর অন্যতম দায়িত্ব হলো দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার থাকা।

অ্যাডভোকেট শারমিন রুবাইয়াত ইসলাম

বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানচর্চা আর কৌশল অবলম্বন করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয় আইনজীবীদের। এজন্য স্টাডি করতে হয় প্রচুর। জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি টেকনিক্যাল বিষয়গুলোও রপ্ত করতে হয় নিয়মিত।

এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট শারমিন রুবাইয়াত ইসলাম বলেন, একজন আইনজীবী মূলত নিজের বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আইনকে প্রয়োগ করে কোনো ব্যক্তি বিশেষের বা সংস্থার আইনি সমস্যার সমাধানের কাজ করে থাকেন। আইনের সঙ্গে নিজের মেধার সমন্বয়ের এই বিচক্ষণতার জন্য‌ই একজন আইনজীবীকে সম্বোধন করা হয় ‘বিজ্ঞ’ (Learned) হিসেবে। এই পেশাকে বলা হয়, কর্তব্যনিষ্ঠ পেশা (Loyal profession)।‌

একজন ব্যক্তি যখন তার আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তখনই সে একজন আইনজীবীর শরণাপন্ন হন। অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রথম আশ্রয়স্থল‌ই হলো একজন আইনজীবী। একজন তরুণ আইনজীবী হিসেবে মনে করি, একজন আইনজীবীর দায়িত্ব শুধুমাত্র কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা কোনো সংস্থার প্রতি নয়, সমগ্র সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব অসীম।

অ্যাডভোকেট আরফান সুলতানা

কঠিন পরিশ্রম এবং একাগ্রতা দিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিয়ে এ পেশার শুরুটা হয় সিনিয়রের হাত ধরে। তার প্রদত্ত প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা এবং পর্যাপ্ত রিসার্চ নবীন আইনজীবীর পেশাগত ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে বলে মনে করেন অ্যাডভোকেট আরফান সুলতানা। তিনি বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রত্যয়, আপসহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সংগ্রামের জন্য যুগে যুগে আইনজীবীরা বিচারপ্রার্থী মানুষের অধিকার রক্ষায় কোর্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।

আইনজীবীরা হলেন ‘Social Doctor’। একটি উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। কেননা উন্নত সমাজ, উন্নত জীবনব্যাবস্থায় অন্যতম নিয়ামক।

ব্যারিস্টার প্রজ্ঞা তাপসী খান

নবীন আইনজীবী হিসেবে অবশ্যই কঠিন প্রতিযোগিতা, নৈতিকতার অনুশীলন নিশ্চিত করা এবং ক্রমপরিবর্তনশীল আইনি বিষয় ও প্রযুক্তির সঙ্গে আপডেট থাকার মতো চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার প্রজ্ঞা তাপসী খান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তরুণ আইনজীবীদের জন্য ভবিষ্যৎ আশাব্যঞ্জক বলে মনে করি। কারণ, আইনি পেশার চাহিদা, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে। যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন মাত্রা ও সম্ভাবনা। ফলে তরুণ আইনজীবীদের বর্তমানে দেশে স্পেশালাইজেশনের জন্য ক্রমবর্ধমান সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে তরুণ আইনজীবীদের মেধা, মনন, কৌতূহল ও উৎকর্ষ বাংলাদেশের আইন পেশার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করি।

বার ও বেঞ্চ একটি পাখির দুটি ডানা। আর এই ডানার সমন্বয়ে গড়ে উঠে বিচার বিভাগ। বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অনবরত চেষ্টা হোক নবীন আইনজীবীদের।

এআইএম/এমএইচটি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর