শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকারকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে আ.লীগ : সালাম

মো. ইলিয়াস
প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০২২, ০৩:২৮ পিএম

শেয়ার করুন:

মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকারকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে আ.লীগ : সালাম

আব্দুস সালাম। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ে নেমে ছিলেন। ২ নম্বর সেক্টরে ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর ফিরেছেন বীরের বেশে।  এখন রাজনীতিতে সক্রিয়। ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মো. ইলিয়াস। 

ঢাকা মেইল: যুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণ করে কিছু বলেন?
আব্দুস সালাম: স্মৃতি তো অনেক; কোনটা বলবো। সে সময় আমি একাদশ শ্রেণিত ছাত্র। স্কুলে থাকতেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। এই সূত্রেই ৬৯ ও ৭০ পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ৭০ এর নির্বাচনের সময় স্বাধীনতার পক্ষে ভোট চেয়েছি। আমরা চেয়েছি দেশকে স্বাধীন করতে; পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা যাবে না। ওরা আমাদের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হিসেবেই মনে করে। এখান থেকে যদি কিছু পেতে হয় তাহলে স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প নেই। 


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল: স্বাধীনতার সময় আপনার রাজনৈতিক অবস্থান কি ছিল?
আব্দুস সালাম: সে সময় আমি ছাত্রলীগ করতাম। আমাদের মূল দল ছিল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই আওয়ামী লীগ তখন নির্বাচনে অংশ নিয়ে ছিলো। তখন যে ছয় দফা দেয়া হয়েছিল তার মূলে ছিল স্বায়ত্তশাসন। সিনিয়র নেতারা তখন একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে পাকিস্তান এটা কখনোই মেনে নেবে না। আমাদেরকে চূড়ান্ত স্বাধীনতার দিকে যেতে হবে। পুলিশ সেনাবাহিনী তারাও নাগরিক হিসেবে সুযোগ-সুবিধা পেত না। সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতো পশ্চিমারা, সে কারণে সেনাবাহিনী পুলিশের মধ্যে একটি ক্ষোভ ছিল। এ কারণে সকলের মধ্যে একটি ক্ষোভ ছিল যে আমরা একটি দেশ চাই। মার্চ মাস যখন এলো তখন ছাত্র-জনতা সকলে আন্দোলনের দিকে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সেটাকে একটি কম্প্রোমাইজ ফর্মুলাতে নিতে চেয়েছে। যেহেতু ছাত্র জনতার সামনে এগিয়ে এসেছে এবং পাকিস্তান মনে করেছে একটা গণহত্যা (২৫ মার্চ) করে বাঙ্গালীদের দমিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু ব্রিটিশ থেকে আমরা দেখেছি বাঙালিরা কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। তাই চূড়ান্ত পর্যায়ে এটা যুদ্ধে রূপ নেয়।

ঢাকা মেইল: কোন মন্ত্র আপনাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে? 
আব্দুস সালাম: দেশপ্রেম, দেশের ভালোবাসা থেকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন দেখেছি রাজারবাগ পুলিশ লাইন সব আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন পুলিশ রাইফেল নিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। এ সময় পুলিশ শহীদ হয়েছে, অনেকে রক্তাক্ত অবস্থায় বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি তাদেরকে কাপড়চোপড় দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করার, যাতে চলে যেতে পারে। পরবর্তীতে ২৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করলাম তখন প্রতিদিন ইকবাল হলে (জহিরুল হক) যেতাম। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য আলোচনা হতো তা শুনতাম। সে হল যখন গেলাম তখন দেখলাম বিধ্বস্ত অবস্থা। জগন্নাথ হল দেখলাম কি যে বিধ্বস্ত অবস্থা। শেষে যখন শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে আসলাম দেখলাম শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়েছে । কাছে যেতে পারেনি দূর থেকে দেখেছি। তখন শিক্ষার্থীদের নিয়ে শহীদ মিনার গিয়েছি, শপথ নিয়েছি যে অস্ত্র তুলে নিতে হবে যুদ্ধ করতে হবে এদের সাথে আর কোনো আপোষ নেই। এই জিনিসগুলো আমার এখনো মনে আছে আর এখনো মনে পড়লে চোখে পানি চলে আসে। 

ঢাকা মেইল: যে প্রত্যাশায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো মানুষ তার কতটুকু পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন?
আব্দুস সালাম: বাঙালিরা সবসময় অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছে। আপনি পেটে ভাত কম দেন; কিন্তু আমাকে অপমান করবেন, আমার ভোটের যে অধিকার রয়েছে সেটা দেবেন না, নির্বাচন করার অধিকার সেটা দেবেন না; এটা কিন্তু এদেশের মানুষ কখনই মেনে নেয়নি। এটা যদি বলি তাহলে বলবো একশ্রেণির মানুষের তা পূরণ হয়েছে। সে সময়ে যে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চালাতে চেয়েছিল, আজ সেই একই কায়দায় দেশ চালানো হচ্ছে। আজকে কোনো গণতন্ত্র আছে? 

ঢাকা মেইল: স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আব্দুস সালাম: প্রথমত একটি জায়গায় একমত হতে হবে যে আমার পক্ষে যাক আর বিপক্ষে যাক গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিতে হবে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ অনেক বেশি তাই নির্বাচনী ব্যবস্থায় ওই ফরমেটিং থাকতে হবে যেন নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকে। যাতে জনগণ ভোট দিতে পারে এবং কোনোভাবেই দলীয় সরকার নির্বাচনে যেন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এছাড়া আমাদের সকলকে একমত হতে হবে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের। বিরোধী দল যে হবে তার মূল্যায়নটা কি হবে, সম্মানটা কি হবে? অর্থাৎ তাকে যদি আমি সেই ফ্যাসিলিটি গ্রান্টেড করতে পারি তাহলে সে বিরোধীদলে যেতে ভয় পাবে না। এখন যেটা রয়েছে বিরোধীদল মানে তাকে দমন করো, নিপীড়ন করো, শেষ করে দাও, জেলে ঢুকাও। অর্থাৎ এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেখানে তার মর্যাদাও রক্ষা করতে হবে। 


বিজ্ঞাপন


ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তানি আমলে রাজনৈতিক কর্মী রাজনৈতিক মামলায় জেলে গেলে যে মর্যাদাটা ছিল এখন কিন্তু সেটা নেই। রাজনীতিবিদদের মর্যাদাটা আমরা নিজেরাই নষ্ট করেছি; এটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। বিরোধীদলের নেতা বা নেত্রী শুধুমাত্র মন্ত্রীর পদমর্যাদা দিলাম, সেটা নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গ্রান্টেড করতে হবে। আজকে যারা সরকারি দলের রয়েছে তারা জানে সরকার আসার কারণে তারা এত নির্যাতন, নিপীড়ন, লুটতরাজ করেছে আজকে এগুলোর জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এবং সেটার জন্য সে মনে করে বিরোধী দলকে যেভাবে নিষ্পেষিত করেছি সেভাবে সেও নিষ্পেষিত হবে সেজন্য ভয় পায়। সরকার আসলে যাতে এ ধরনের নিষ্পেষিত করতে না পারে সরকারি মেশিনারিকে ব্যবহার করতে না পারে এটার জন্য এক হতে হবে। অর্থাৎ রাজনীতিকে সংস্কার করতে হবে। 

ঢাকা মেইল: অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনো অবহেলিত। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিষয়টি আপনার কাছে কেমন লাগে?

আব্দুস সালাম: এটা অবশ্যই দুঃখজনক। আজকে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন শহীদ হয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ করতে গিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন তার পরিবারকে যেভাবে সম্মান দেয়া হয়। আবার যিনি পঙ্গু হয়েছেন তাকে আজীবন যে সম্মান করা হয়। আজকে আমরা যুদ্ধ করে একটি দেশ এনেছি; এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা আর কত বছর বাঁচবে? ১০ বছরের মধ্যে দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধের সব শেষ হয়ে গেছে। এই সময়টুকু ন্যূনতম তাকে যদি সম্মান দিতে না পারেন, কয় টাকা ব্যয় হয়? আজকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। সব মুক্তিযোদ্ধা তো সেটা চায় না আর হাত পাতে না। 
এরকম অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে যারা কখনোই কম্প্রোমাইজ করে নাই, স্বাধীনতার পর লুটপাট করেনি তাদের অবস্থা আজ খেতে পারছে না; খাবার জোগাড় করার জন্য কষ্ট করছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার কাছে মনে হয় এটা অপমান করা। যারা দেশের জন্য পঙ্গু হলেন, অসহায় এই যা তাদেরকে ভরণপোষণ দিতে পারবে না। আজকে একজন মন্ত্রী হয়ে বিশাল অট্টালিকা থাকবেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই পারছেন। আজকের যদি দেশ স্বাধীন না হতো তাহলে মন্ত্রী-এমপি সরকারপ্রধান কিছুই হতে পারতেন না। যাদের বিনিময় এটা তাকেই মর্যাদা দিতে কার্পণ্য বোধ করছি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দলাদলি। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোন দল নেই। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের। আজকে আওয়ামী লীগ মনে করে আওয়ামী লীগ করলেই সে মুক্তিযোদ্ধা। অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন তিনি আওয়ামী লীগ করেন না কিন্তু ভয়ের চোটে; সম্মানি হারানোর ভয়ে আতঙ্কে থাকেন। দলীয়করণের কারণেই আজকে দেশের এই অবস্থা হয়েছে।

ঢাকা মেইল: দেশে এখনো মুক্তি যুদ্ধ বিরোধী তৎপরতা দেখা যায় আপনার অভিমত কি? 

আব্দুস সালাম: একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এগুলো কখনোই মেনে নিতে পারি না। যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি গুলো একটি স্বাধীন দেশে এখনো... আর এটা আমি বিশ্বাস করি না, বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা তো দেশে থাকার যোগ্য না। তারা তো দেশটাকেই স্বীকার করল না। এটা নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করে। যদি মনেই করে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি; আর জামায়াত ও যদি মনে করে বাংলাদেশের পক্ষে রাজনীতি করবে না; তাহলে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে না কেন। আওয়ামী লীগ তো সেটা করে না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজাকারকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে তাদের বেনিফিটের জন্য, অন্য কিছুই নয়। আওয়ামী লীগ সরকার এত বছর ক্ষমতায় রয়েছে তারা সংবিধানকে কেটে ছিঁড়ে নতুন করে তাদের পক্ষে বানিয়েছে। তাহলে এটা করতে পারে না? অর্থাৎ এটা রাজনৈতিকভাবে যখন প্রয়োজন হবে তখন জামায়াতকে ব্যবহার করবে; আবার যখন প্রয়োজন হবে জামায়াতের কাছে গিয়ে দোয়া চাইবে, আবার যখন প্রয়োজন হবে পাবলিকের কাছে জামায়াতের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপানোর জন্য বক্তৃতা দেবে। 

ঢাকা মেইল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। 

আব্দুস সালাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।


এমই/ একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর