শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

‘মরব না হয় মারব, এই কনসেপ্ট নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম’

কাজী রফিক
প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০২২, ০৩:২৫ পিএম

শেয়ার করুন:

‘মরব না হয় মারব, এই কনসেপ্ট নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম’

মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ১৯৪৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যারা দেশ স্বাধীনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের অন্যতম তিনি। যুদ্ধকালীন ২ নং সেক্টরের ক্র্যাক প্লাটুনের কমান্ডার হিসেবে বীরত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘বীর বিক্রম’ খেতাব। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মায়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর বর্তমান এই সদস্য অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাক্ষাৎকারে ১৯৭১ সালের স্মৃতিচারণ করে বিভিন্ন কথা বলেন ‘বীর বিক্রম’ খেতাব পাওয়া অকুতোভয় এই যোদ্ধা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা মেইলের স্টাফ রিপোর্টার কাজী রফিক।


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল: ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতটা কেমন ছিল?

মোফাজ্জল হোসেন: স্বাধীনতার মাসে আপনাদের সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ১৯৭১, ২৫ শে মার্চ কালরাত। এই রাতে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিকে ট্যাংকসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছিল। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, রেল স্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত করে। রাজারবাগ, পিলখানায় অগণিত বাঙালিকে সে রাতে হত্যা করে। কত লোক মারা গেছেন তার কোনো হিসাব নেই। সেই রাতের কথা আসলে এখন আমাদের বুক ধড়ফড় করতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যে- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। সেই নির্দেশ মোতাবেক আমরা ঢাকার প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড তৈরি করি। আমাদের হিসাব ছিল ব্যারিকেড দিলে পাকহানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করতে পারব। গাছ কেটে আমরা রাস্তায় ফেলতাম, দেওয়াল করে রাস্তায় আটকে দিতাম। আমি তখন ছিলাম সেগুনবাগিচায়। মিউজিক কলেজ হোস্টেলে থাকতাম। আমি তখন বিএ পাস করেছি। মাস্টার্সে ভর্তি হব। মিউজিক কলেজের হলে থাকি। সেগুনবাগিচা প্রেসক্লাবের সামনের যে রাস্তাটা আছে সে রাস্তায় আমরা ব্যারিকেড দেই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। আমাদের মিউজিক কলেজের সকল ছাত্র-ছাত্রী, সবাই এক সঙ্গে। গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছি রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা, পৌনে এগারোটা বাজে। খুব শুনশান অবস্থা। যত মুক্তিকামী মানুষ ছিল তখন তারা রাস্তায়। তারা স্লোগান দিচ্ছে জয় বাংলা, জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনব, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার দেশ পিন্ডি না, ঢাকা-ঢাকা-ঢাকা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো। এই স্লোগানে মুখরিত ঢাকা শহর। স্লোগান আর স্লোগান।


বিজ্ঞাপন


হঠাৎ দেখলাম একটা আওয়াজ। আকাশটা পুরো লাল হয়ে গেল। ওপর দিকে তাকালাম আমরা। তারপরেই গুলির শব্দ। গুলি যে কোন দিক থেকে আসছে বুঝতে পারছি না। গুলির শব্দ, মাঝেমধ্যে ধুম ধুম ধুম গোলার আওয়াজ। আমরা রাস্তা থেকে সরে গেলাম। রাস্তা থেকে সরে গিয়ে যার যার নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা মিউজিক কলেজের হোস্টেলে এসে আবার গেটে তালা দিয়ে ভেতরে লাইট অফ করে দিয়ে দোতলায় বইসা রইছি। মিউজিক কলেজের উল্টোদিকে পার্কের সামনে যে রাস্তাটা মৎস্যভবন এখন, সেখান দিয়ে গড় গড় করে ট্যাংক যাচ্ছে। আর স্পার্ক করে। ওরা যখন গোলা মারে তখন পুরা আকাশটা আলোকিত হয়ে যায়। তখন দেখা যায় কিছু কিছু। সারারাত গোলাগুলি হলো।

মানুষের আত্মচিৎকার, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে আগুন জ্বলছে, কমলাপুর রেল স্টেশনে আগুন জ্বলছে, পুলিশ লাইন্স আগুন জ্বলছে রাজারবাগে। কোথায় যে আগুন নাই! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, মহসিন হলে আগুন আর আগুন। একদিকে আগুন, গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার। এভাবে সারা রাত কেটে গেল। সকালে ফজরের নামাজ হইলো। আমরা তখন মিউজিক কলেজ থেকে বাড়ি মজুমদার আমাদের পন্ডিত মিউজিক কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি বাপ্পা মজুমদারের বাবা। তাদেরকে নিয়ে আমরা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট সেগুনবাগিচার তার বাসায় গিয়ে উঠলাম।

ঢাকা মেইল:  ২৬ মার্চ থেকে থেকে ঢাকার অবস্থা কেমন ছিল?

মোফাজ্জল হোসেন: ২৬ তারিখ সারাদিন কারফিউ। মানুষের কোনো সারা শব্দ নাই। খালি গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়। ২৭ তারিখ সকালে ২ ঘণ্টা, সাতটা থেকে নয়টা কারফিউ শিথিল ছিল। আমার এক বন্ধু আনু, সে মুক্তিযোদ্ধা। তাকে নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরলাম। প্রথম গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। গিয়ে দেখলাম যে সারা বিশ্ববিদ্যালয় খাঁ খাঁ করতেছে। কোনো মানুষ নাই। দরজা-জানালা ভাঙা। বই-খাতা সব চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। হলের ভেতরে ঢুকলাম দেখি গণকবর। এখান থেকে বের হয়ে গেলাম সদরঘাটে। সদরঘাটে গিয়ে দেখলাম টার্মিনালে অজস্র যাত্রীর লাশ। একটার পর একটা লাশ পড়ে আছে। রক্তে চপ চপ করছে। কিছু লোক নদীতে পড়ে আছে, ঢেউয়ে ভাসছে লাশ। ওখান থেকে বের হয়ে আসার পরে আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে আসলাম। অনেক বন্ধুর সাথে দেখা। বলল, আমাদের এক বন্ধু দুলালকে মেরে ফেলছে। বন্ধু মানুষ মারা গেছে শুনে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি ৭০/৮০ টালা লাশ। ওর মধ্যে একটা ফর্সা মোটা লোক। দেখে মনে হচ্ছে দুলাল। পরে দেখি না দুলাল না।  ৮ তারিখে সকাল ৭টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। ওই সময় আমরা বারি মজুমদারকে নিয়ে বের হলাম।

৩১ মার্চ আমরা জিনজিরা উঠলাম। ঐখান থেকে ১ তারিখ সকালে আমাদের পরিকল্পনা ছিল আগরতলা যাওয়ার। কিন্তু ১ তারিখ সকালবেলা জিনজিরা হামলা করল। চতুর্দিক থেকে গুলি। একবার ডান দিকে, একবার বাম দিকে দৌড় দেই। একই জায়গায় ঘুরতেছি। কিন্তু আমরা কিন্তু সঠিক পথে বের হতে পারতেছি না। গুলি আর গুলি।

একটা দুর্ঘটনা ঘটল। বারি মজুমদারের বড় মেয়ে নাম মিতু। তখন তার বয়স নয় কি সাড়ে নয়। সে হাত থেকে ছুটে যায়। ধলেশ্বরী নদী পার হতে গিয়ে নৌকা ডুবে যায়। তখন মিতু সেখানে ডুইবা যায়। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। বারি মজুমদার আর বৌদি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিশ্বাস করছে যে তাদের মেয়ে মারা যায়নি। তাই তারা তাঁর মৃত্যু দিবস পালন করেন না।

সেখান থেকে আমরা আগরতলা চলে গেলাম। প্রথমে মতিনগর সেখান থেকে মেলাঘর, তারপর দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ।

MAYA-1ঢাকা মেইল: কার কথা বা কোন কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলেন?

মোফাজ্জল হোসেন: নির্দেশ ছিল বঙ্গবন্ধুর। কারণ হলো পাকিস্তানের অত্যাচার, নির্যাতন, যুলুম। এই অত্যাচার-নির্যাতনের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। বাংলাকে মুক্ত করতে হবে। বাংলা মাকে মুক্ত করতে হবে। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে গিয়েছিলাম। দুইটা শব্দ- মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী। হয় মরব, নয় মারব, এই কনসেপ্ট নিয়েই আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ই মার্চের ভাষণ সারাক্ষণ কানে বাজতো। এই ভাষণে ছিল মূলমন্ত্র। এই ভাষণ আর তার সঙ্গে ছিল ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। এই দুইটা একত্রে করে আমরা যুদ্ধ করছি। আমরা কিছু একটা করার আগেই বিসমিল্লাহ বলে ‘জয় বাংলা’ বলতাম, আর কিছু শেষ হইলেও ‘বিসমিল্লাহ’ বইলা ‘জয় বাংলা’ বলতাম। আমরা মাত্র নয় মাসে, নয় মাসের আগেই আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পারছি। এখনো বিশ্বের অনেক দেশেই তা পারে নাই।

ঢাকা মেইল: স্বাধীনতার স্বাদটা কখন, কীভাবে পেলেন?

মোফাজ্জল হোসেন: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর আমরা মুক্তিযুদ্ধের নেতাকে ফিরে পেয়েছি। সেদিনই কিন্তু দেশ পূর্ণাঙ্গভাবে স্বাধীন হয়েছে। এর আগে কিন্তু অসমাপ্ত ছিল। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশের পা রাখলেন, আমরা মনে করি তখনই বাংলাদেশ পরিচ্ছন্নভাবে স্বাধীন হয়েছে। সেদিন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

ঢাকা মেইল: অনেক মুক্তিযোদ্ধা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, তাদের জন্য কিছু বলার আছে?

মোফাজ্জল হোসেন: আমরা যখন যুদ্ধে গিয়েছি, তখন কিন্তু কিছু পাওয়ার জন্য যাইনি। আমাদের কিছু দিতে হবে, এটা করতে হবে, এটা পাবো এমন কিছু ছিল না। কিছু পাওয়ার জন্য আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি নাই। উদ্দেশ্য একটাই, হয় মারব অথবা পাকিস্তানিদের মারব। বাংলা মাকে মুক্ত করব। বাংলাদেশ স্বাধীন করব। আপনি যে কথাটা বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে অসহায়। বাংলাদেশের বয়স ৫১ বছর। এর ভেতর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল মাত্র ২১ বছর। বাকি ৩০ বছর কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় ছিল। এরাই তো দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রাপ্তি ছিল, আশা ছিল ধুলিস্যাৎ করে দিছে। ওই ৩০ বছর যদি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতা থাকতো আজকে এই প্রশ্ন আপনি করতে পারতেন না।

জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সকল শহিদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে ২০০০ টাকা করে দিয়েছেন। তখনকার ২০০০ এখন কত টাকা? ২০ লাখ টাকা। ২০০০ টাকা দিয়ে এক বিঘা জমি কেনা যায়। তারপর যা যা দরকার এই মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট দেখেন। বঙ্গবন্ধু কল্যাণ ট্রাস্ট করেন। পৃথিবীর এমন কোনো দেশের নাই যারা স্বাধীন হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে বইসা বইসা ২০ হাজার টাকা করে দেয়। ২০ হাজার টাকা চাট্টিখানি কথা না। আজকে একটা মাস্টার ডিগ্রি ছেলের ২০ হাজার টাকায় চাকরি পায় না। কষ্ট হয়। আর আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমি নরমাল যুদ্ধ করেছি খালি, আজীবন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা ভাতা পাব। ঘরে বইসা বইসা, বলতে হয় না। মাসের ১ তারিখ হইলেই চেক চলে আসে। তারপরে ফ্রি মেডিকেল, ভাতা, মুক্তিযোদ্ধার অগ্রাধিকার সব জায়গায়। আমি হলাম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এর চাইতে সম্মান আর কি আছে? আমার আজকে আমি মারা গেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্যালুট দিয়ে তাকে অজপাড়া গাঁয়ে গিয়ে সমাধিত করে। এই সম্মান কে দিছে? জননেত্রী শেখ হাসিনা দিছে। আমরা স্যালুট করি তাকে।

ঢাকা মেইল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মোফাজ্জল হোসেন: ঢাকা মেইলকেও ধন্যবাদ।

কারই/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর