শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সহজ ছিল না জয়িতা পলির ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ হয়ে ওঠা

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ১১ মার্চ ২০২২, ১২:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

সহজ ছিল না জয়িতা পলির ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ হয়ে ওঠা
রাজশাহী জেলার কাশিয়াডাঙ্গা থানার বাসিন্দা মো. আবু হাসান। যদিও হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ে কাছে তিনি জয়িতা পলি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে অনেকের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা। এর পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করছেন। পেয়েছেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যদিও এ যাত্রা মোটেই সহজ ছিলো না। তার এ দীর্ঘযাত্রার আদ্যপান্ত নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেইলের সঙ্গে।

ঢাকা মেইল: আপনার নামের পরিবর্তন এবং বেড়ে উঠা নিয়ে কিছু বলতেন...


বিজ্ঞাপন


জয়িতা পলি: স্বাভাবিক দুই একটা সন্তানের মতোই আমার জন্ম। ছেলে হয়েই জন্মেছি। সময়ের আবর্তে নারীসুলভ আচরণ এবং আমার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে নামের পরিবর্তন। মো. আবু হাসান থেকে নাম হয় জয়িতা পলি। জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। শুরু থেকে যদি বলি— আমার জন্ম মধ্যেবিত্ত পরিবারে। জন্মের পর যখন আমর বয়স ৬-৭ বছর, আমি শারীরিকভাবে ছেলে ছিলাম। কিন্তু মানসিকভাবে নিজেকে নারী ভাবতাম। এই ভাবনাটা আমার পরিবার সহজেই মানেনি। একসময় আমার মা মেনে নিলেও বাবা কখনোই মেনে নিতে পারতেন না। অবহেলা, অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। সন্তান হিসেবে কখনোই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি। জিজ্ঞেস করেনি, ‘তুমি এমন করছো কেন?’ নির্যাতন আর অবহেলায় কেটেছে। এ নির্যাতনের একটা ভাগ মাকেও সহ্য করতে হতো। বাবা প্রায়শই গায়ে হাত তুলতেন। মা বাধা দিতে চেষ্টা করতেন কখনো কখনো। তখন মাকেও নির্যাতনের শিকার হতে হতো। গালিগালাজ করতেন। 

ঢাকা মেইল: এমন বাস্তবতার মাঝেও স্কুলে যাওয়া হয়েছিলো?

জয়িতা পলি: আমি কখনোই নিজেকে ছেলে হিসেবে নিতে পারিনি। যখন আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হলো, বাবা বললেন— না, আমাকে স্কুলে ভর্তি করা যাবে না। বললেন, একে স্কুলে ভর্তি করিয়ে আমার লাভ কি? এর কোথাও কোনো জায়গা নাই। আমাকে চাকরি দেবে কে? শুধু শুধু পড়াশোনায় টাকা-পয়সা নষ্টই হবে। তবে মা থেমে থাকেননি। মায়ের একক সিদ্ধান্তে স্কুলে ভর্তি হই। পড়াশোনা শুরু করি।

poli


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল:  কখন এ নারী সত্তাটা আরও পেয়ে বসে নিজের মধ্যে?

জয়িতা পলি: যখন আমি ক্লাস সপ্তম শ্রেণিতে উঠি। আমার ভেতরে নারী সত্তাটা আরও বেশি কাজ করতে শুরু করে। নিজেকে একজন নারী হিসেবে উপস্থান করা আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে স্কুল থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়- স্কুলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা সমস্যা করছে। অভিভাবকরা সমস্যা করবে। পড়াশোনা বন্ধ। বাসায় থাকলাম ১-২ বছর। চেষ্টা কিংবা আশা কখনোই ছাড়িনি। এরপর আবারও স্কুলে ভর্তি হলাম। বলে রাখি বাবা শুরু থেকেই পড়াশোনার খরচ দিতেন না। মা সংসারের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে আমার স্কুলে পাঠাতেন। যখন দশম শ্রেণিতে উঠলাম, স্কুল থেকে বলা হলো— শুধু পরীক্ষার সময় আসবে, এছাড়া স্কুলে এসো না। কারণ, ক্লাস নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি উগ্র টাইপের থাকে। যা আমার সঙ্গেই বেশি হতো। আমি স্কুলের টয়লেটে গেলে তারা বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দিতো। নিজের ভেতরে সব সময় কাজ করে আমি নারী। কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপট, পারিবারিক চাপের করণে ছেলে হিসেবেই থাকতে হতো। ছেলেদের পোশাক পরে কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম না। স্বস্তি পেতাম না। মনে হতো কোথাও যেন একটা বাধা।

ঢাকা মেইল: এতো বাধার মধ্যেও পড়াশোনা চালেয়ে নিয়েছেন কিভাবে?

জয়িতা পলি: স্কুলে যেতাম। সহপাঠীরাই শুধু নয় দেখতাম শিক্ষকরাও আমার আড় চোখে তাকাতো। অন্য শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে যেভাবে কেয়ার করা হতো, আমার বেলায় তা করা হতো না। একপর্যায়ে স্কুল থেকে বলা হলো, স্কুলে তোমার আসার দরকার নাই। বাসায় থাকো। আমরা (শিক্ষকরা) হেল্প করবো। আমার জন্য তাদের সমস্যা হচ্ছে। উপায় না পেয়ে তাতেই রাজী হয়ে গেলাম। তারপর থেকে বাসা থেকেই পড়াশোনা। কষ্ট হয় মনে করলে, যখন ফর্ম ফিলাপ করবো, আব্বা টাকা দেবে না। তখকার সময় ২০০৬ সাল। নয়’শ টাকা লাগবে। একপর্যায়ে বাসায় যতো মুরগি ছিলো মা সব বিক্রি করে দিলো। কোনোমতে ফর্মফিলাপ করলাম। এরপর পরীক্ষা আসলো। মনে পড়ে পরীক্ষা দিতে মাত্র ২ দিন গাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তার পর আর ভাড়ার টাকা নাই। পরীক্ষাতো দিতেই হবে। যেদিন পরীক্ষা খুব সকালে উঠতাম। ভোর ৬টায় উঠে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছাতাম পরীক্ষা কেন্দ্রে। আবার ১১-১২ কিলোমিটার পথ হেঁটে ফিরে আসতাম বাসায়। এসএসসি পাশ করার পর আমার নারী সত্তাটা আরও বেশি কাজ করতে শুরু করে। নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে বাবার টর্চার বাড়তে লাগলো। সঙ্গে মায়ের উপরও টর্চার বাড়তে থাকে ক্রমাগত। বাবা প্রতিনিয়ত বলতেন, হয়তো নিজের জীবন শেষ করে দে, নয়তো কোথাও চলে যা। আমার আরও দুইটা সন্তান আছে। তাদের ভবিষ্যৎ আছে। যা ছিলো নিত্যদিনর ঘটনা। পরে বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

poli

ঢাকা মেইল: এর পরের সংগ্রাম নিয়ে জানতে চাই। কোথায় গিয়েছিলেন...

জয়িতা পলি: মায়ের ধারণা ছিলো, আব্বা রাগের মাথায় বলেছেন। যা প্রতিনিয়ত বলতেন। পরে হয়তো ঠিক হয়ে যাবেন। কিন্তু না। এটাই ছিলো ওনার একমাত্র সিদ্ধান্ত। যখন একপর্যায়ে আমি রাগ করে বাসা থেকে চলে যাচ্ছি, আত্মীয়-স্বজনদের বাবা বললেন, আমাকে তাদের বাসায় অন্তত ২-১ দিন রাখতে। দেখলাম আত্মীয়-স্বজনদের কেউই আমাকে নিতে চাইলো না। কেউ বললো না ১দিন বা ২দিন আমার বাসায় থাকো। চলে আসি হিজড়া সম্প্রদায়ের যিনি গুরুমা ছিলেন ওনার কাছে। গুরুমাকে বললাম, আপনার বাসার সমস্ত কাজ আমি করবো। কিন্তু আমাকে একটু পড়াশোনার সুযোগ দিতে হবে। আর আপনার পেশাটাকে (টাকা তোলা) আমি সম্মান করি, কিন্তু আমি এটাতে যেতে পারবো না। যদি এমনটা হয় আমাকে থাকতে দিতে পারেন। ওনি ভালো মানুষ ছিলেন। বললেন, ঠিক আছে। তুমি থাকো।

poli

ঢাকা মেইল: আপনার মা সবসময় আপনাকে মনে রাখতেন। গুরুমায়ের কাছে যাওয়ার পর কেমন কেটেছে সময়গুলো?

জয়িতা পলি: কিছুদিন ওনার (গুরুমায়ের) কাছে থাকার পর শুনতে পাই মা আমার জন্য অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। আমি নিজেও মায়ের জন্য অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। কোথাও শান্তি পাচ্ছি না। মায়ের মুখ দেখার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে গুরুমা আমাকে বললেন, ওনার যে প্রতিষ্ঠানটা আছে ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’ সেখানে চাকরি করতে। ওখানে চাকরি করতে লাগলাম। কিছু টাকাও পেতাম। মাকে দেখার জন্য আমাদের বাড়ির পাশে একটা বাড়ি ভাড়া নিলাম। একদিন মা ফোন করে বললেন, বাসায় কিছু একটা রান্না হয়েছে। আমাকে ডেকেছেন। আম্মা বললেন, তোমার বাবা বাসায় নাই, তুমি একটু আমার বাসায় আসো। আমি বাসায় গেলাম। মায়ের সাথে দেখা হলো। আম্মা আর আমি একসাথে খাচ্ছি এমন সময় আমার বাবা চলে আসে। তখন আম্মা না পারছে আমাকে বাহিরে পাঠিয়ে দিতে, যেহেতু আমি খাবার খাচ্ছি। না পারছে খাটের তলে লুকিয়ে রাখতে। একপর্যায়ে আম্মা বললো, তুমি থাকো আমি দেখছি। আব্বা এসে আমাকে বলছেন, তুই আমার সন্তান না? তোকে পরিচয় দিতে আমার ‘ঘৃণা’ হয়। তুই কোথাও আমার পরিচয় দিবি না। যে ভাতটা গিলছিস, এ ভাতটাও আমার। এমন ভাবে তুচ্চ-তাচ্চিল্ল করছেন, আমি তো কষ্ট পেয়ে পেয়ে এতো বড় হয়েছি। আমার কাছে এ বিষয়টা কিছুই মনে হচ্ছে না। তখন মায়ের দিকে তাকালাম, দেখি তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। যেন তার ভাতের থালা ভিজে যাচ্ছে। আর তিনি এতোই অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। যেন তার পৃথিবী উল্টে গেছে। তখনি আমি প্রতিজ্ঞা করি, আজ আমার জন্য মা এতোটা অপমান অপদস্ত হতে হচ্ছে একজন নারী বলে। কিন্তু তারও তো (বাবার) সন্তান আমি। সমস্ত দোষ আমার মায়ের উপর দিচ্ছেন। আমার জন্মের সঙ্গে যেন বাবার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, সব দোষ মায়ের। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার মা যেন এসকল কথার জবাব দিতে পারে। আমি আমার বাবার পরিচয়ে পরিচিত হবো না। আমার বাবা যেন গর্ববোধ করে বলেন,  এ সন্তানটা আমার। এর পর কেটে গেলো দীর্ঘ সময়।

ঢাকা মেইল: ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প জানতে চাই

জয়িতা পলি: আমি ২০১৪ সালে ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ থেকে ৪ দিনের একটা ট্রেনিং পাই। সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু। এর পর সমাজসেবা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একটা প্রতিষ্ঠান ছিলো, ওখান থেকে আমাকে একটা সেলাই মেশিন আর আট হাজার টাকা দেয়। এ পুঁজি দিয়েই আমার যাত্রা। প্রথমে ১৭ জন নারী সহকর্মী নিয়ে কাজ শুরু করি ‘ডিএ ফ্যাশন হাউজ’। সমাজে যারা অবহেলিত নারী তাদের হাতের কাজ শেখাই। ১৭ জন থেকে শুরু হয়ে এখন আমার এখানে প্রায় সাড়ে চারশত নারী কাজ করে। যাদের অনেকেই হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার। আমাকে পেছন থেকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছে বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। যাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার ভেতরে একটা লক্ষ্য ছিল, উদ্দেশ্য ছিলো। সেটাকে অরও স্পিড এবং শক্তিতে পরিণত করেছে তারা। নিজে ঘুরে দাঁড়ানোর পরও পরিবার খুব একটা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেনি। এতোকিছুর পরও আমার বাবার যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো, তিনটা গাড়ি ছিলো সবকিছিু ভাইকে দিয়ে দেয়।

poli

ঢাকা মেইল: পরিবারে বর্তমানে আপনার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই।

জয়িতা পলি: ভাইকে সম্পত্তির সবকিছু দেওয়ার পরে আমাকে পরিবার ডেকেছে। বলেছে, পরিবারে আসো। পরিবারে গিয়েছি। এখন তাদের সঙ্গেই থাকি। একটা জিনিসি দেখি এখন, আমি যদি একটু অসুস্থ হয়ে যাই বাবা পাগল হয়ে যায়। আমার সেবা যত্ন বাবাই এখন করেন। আমার মন যদি একটু খারাপ হয়, বাবা বারবার আসে। জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা কিনা। বর্তমানে পরিবারের সমস্ত সিদ্ধান্ত আমার উপরে। যে আত্মীয়-স্বজন এক দিনের জন্য আমাকে তাদের বাসায় জায়গা দেয়নি, তারা এখন মাঝে মাঝেই দাওয়াত দেয়। আমার কাছ থেকে পরামর্শ নেয়। সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি। 

ঢাকা মেইল: সবশেষ জানতে চাইবো, এখন পর্যন্ত কি কি সম্মাননা পেয়েছেন...

জয়িতা পলি: আমি আমার কমিউনিটির জন্য কাজ করছি। তাদের অধিকারের জন্য কাজ করছি। সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য কাজ করছি। আমি ২০১৭ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ‘জয়িতা পুরস্কার’ , ২০১৮ সালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে Woman of the World ( WoW ) ‘ওয়াও পুরস্কার’, ২০১৯ সালে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি থেকে  ‘Humanitarian Award’ বা ‘মানবিক পুরস্কার’ , ২০২০ সালে এসএমই পণ্য মেলা থেকে রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা’ হিসেবে পুরস্কৃত হই। এছাড়াও ২০২১ সালে রাজশাহী জেলার হিজড়া সম্প্রদায় ভিত্তিক সংগঠন ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’ এর পক্ষ থেকে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ পাই।


ডিএইচডি/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর