শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

‘৭ই মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম’

মো. জাহিদ হাসান মিলু
প্রকাশিত: ০৭ মার্চ ২০২২, ০৮:৪৬ এএম

শেয়ার করুন:

‘৭ই মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম’
ছবি : ঢাকা মেইল

১ জানুয়ারি ১৯৫৪। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার ভগবানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নগেন কুমার পাল। বাবা মৃত অশ্বিনি কুমার পাল। মা মৃত শ্রীবালা পালের কনিষ্ঠ ছেলে তিনি। যুদ্ধের সময় নগেন কুমারের বয়স আনুমানিক  ১৭। সেসময় হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। ছিলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য। 

মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের। স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঙালিদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রেডিওতে সেই ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হই। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল যুদ্ধে যোগদান করি। কয়েকজন বন্ধুসহ সর্বপ্রথম চলে যাই মালন ক্যাম্পে। ৭ দিন পর প্রশিক্ষণের জন্য যাই ভারতের উত্তর প্রদেশের টেনডুয়ায়। ১ মাস প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আমাদের পাঠানো হয় ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার গদাগারীতে। 


বিজ্ঞাপন


সেসময় জানতে পারি হরিপুরে রাজাকার ও ‘মালদইয়া’ নামে এক শ্রেণির লোক রাতের অন্ধকারে বাঙালিদের ওপরে হামলা করছে। সেখবরে ১০ থেকে ১২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ চলে যাই সেখানে। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। গুলিবিদ্ধ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা টিমের কমান্ডার কেরামত আলী চৌধুরী। গরগোড়িয়া বিলের কাছে নাড়ি ভূড়ি বেরিয়ে পড়ে থাকেন তিনি। আমরাও পেছন থেকে আক্রমণ করতে করতে এগিয়ে যাই। গামছা দিয়ে তার পেট বেঁধে দ্রুত ভারতের কৈলাডাঙ্গীতে পাঠানো হয় তাকে। সেখান থেকে বিএসএফ-এর গাড়িতে করে চিকিৎসার জন্য রায়গঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সে যাত্রায় বেঁচে ফিরেছেন তিনি। এই তো ৫/৭ বছর আগেই মারা গেছেন তিনি।

কেরামত আলী চৌধুরীর বাড়ি ছিল হরিপুরের ভাতুরিয়ার জিগাঁও গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে দেশকে স্বাধীন করতে যেমন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসেছিলেন, তেমনি তার পরিবারেরও একটা করুণ ইতিহাস আছে। প্রাণের মায়ায় সবাই যখন দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছিল, তখন কেউ কেউ দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। দেশের মাটি আঁকড়ে ছিলেন কেরামত আলী চৌধুরীর বড় ভাই। তখন ওই এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর থেকেও ভয়ঙ্কর ছিল স্থানীয় কিছু লুটেরা বাহিনী, অর্থাৎ রাজাকার ও ‘মালদইয়া’ নামে পরিচিত স্বাধীনতাবিরোধীরা। তারা সুযোগ বুঝে লুটপাটসহ অত্যাচার করতো বাঙালিদের। তাদের হাত থেকে বাঁচতে কেরামত আলীর বড় ভাই বন্দুক নিয়ে তৈরি থাকতেন সব সময়।

Bangabandhu's speech on March 7

এক দিন সুযোগ বুঝে কেরামত আলীর বড় ভাইকে তুলে নিয়ে যায় রাজাকার ও মালদইয়ারা। হাত পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে রাখে তাকে। একপর্যায়ে তার শরীরের চামড়া ছিঁড়ে লবণ লাগিয়ে দেয় তাকে। এমন অমানুসিক নির্যাতনে কারণেই মূলত যুদ্ধে যোগদেন কেরামত আলী চৌধুরী। এমন অসংখ্য করুণ মৃত্যুর স্মৃতি দিয়ে মোড়ানো আমাদের এই মাটি। শহীদদের আত্মত্যাগে সিক্ত আমাদের এই দেশকে তাদের স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হবে। তাই ত্যাগ করতে শিখতে হবে। তাহলেই শহীদের সেই ত্যাগ সার্থক হবে। নগেন পাল আবারও ফিরে গেলেন ৭১-এর দিনগুলোতে। বলতে লাগলেন আরও কিছু স্মৃতির কথা। 


বিজ্ঞাপন


বালিহাড়ার সেই ক্যাম্প থেকে কিছুদিন তারা চলে আসেন ধীরগঞ্জে। সেখানে দিনভর থাকতে হতো পরিত্যাক্ত ইউনিয়ন পরিষদে। রাত হলে চলে যেতেন ভারতে। সেসময় ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে ছিল না কাটা তারের বেড়া। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত। ধীরগঞ্জে তাদের ক্যাম্প থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে যাদুরানীতে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। কখনও তার আমাদের ওপর হামলা করতো কখনও আমরা তাদের ওপর। আর এভাবেই চলতে থাকে আমাদের যুদ্ধ।

এর আগে এক দিন কামারপুর এলাকায় হঠাৎ পাকিস্তানিরা নির্বিচারে গুলি চালায়। সেদিন হত্যা করা হয় ৪ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে। তাদের মধ্যে বাঙালি, আদিবাসী ও কিছু ভারতীয় মানুষ ছিলেন। বর্তমানে সেই স্থানে বদ্ধভূমি করা হয়েছে। আগে সেখানে একটা বড় গর্ত ছিল। মানুষদের হত্যা করে লাশগুলো ওই গর্তে ফেলে দিতো পাকিস্তানিরা।

একবার বুজরুকে আমরা অস্ত্রসহ দুই রাজাকারকে আটক করি। তখন হরিপুর এলএসডি গুদামে ছিল মিত্রবাহিনীর ক্যাম্প। তাদের নিয়ে যাই সেই সেখানে। তাদের অস্ত্রগুলো নিয়ে আমরা ফিরে আসি আমাদের ক্যাম্পে। বুজরুকের কিছু বাঙালি তাদের আবাদি ধান দেখতে ও কাটতে যেত। পাকিস্তানিরা ওই গ্রামের মানুষদের ধরে নিয়ে নাগর নদীর পাশে গণহত্যা চালায়। ওই ঘটনা জানতে পেরে আমরাও ফায়ারিং করতে করতে এগিয়ে যাই সেখানে। তখন কিছু বাঙালিকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ১০ থেকে ১২ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসি। কয়েকদিন পরে আবার হঠাৎ পাকিস্তানিরা সেই এলাকায় হামলা চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। এর পর আমরা ত্রিমুখী আক্রমণ করে যাদুরানীতে পাকিস্তানি ক্যাম্পের দিকে এগোতে থাকি। একপর্যায়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ওই ক্যাম্পে গিয়ে দেখি ২৫/৩০ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার বারুদের গোলা এবং গুলিতে মরে পড়ে আছে।

এছাড়াও মানিকখারী গ্রামের মালদইয়ারার পাশে একটি বাঙালি পাড়া ছিল। সেখানে ৫০/৬০ জনকে হত্যা করেছিল বিহারিরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের ঘর বাড়ি। পরে আমরাও তাদের (বিহারি) বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেই। সেসময় পুরো হরিপুর শ্মশানের মতো হয়ে যায়। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া দিনে এবং রাতে কেউই বিচরণ করতো না। বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে বহু পাকিস্তানি সৈন্যকে মেরেছি। হাতে নাতে ধরেছি অনেক রাজাকারকে।

এভাবেই বিভিন্ন সময়ে শত্রুদের পরাস্ত করে ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওকে শত্রুমুক্ত করেছি। সর্বপ্রথম ঠাকুরগাঁওয়ের সদর থানায় উত্তোলন করেছি জাতীয় পতাকা।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর