শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নীরব ঘাতক হাড় ক্ষয়, বেশি ঝুঁকি পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২০ অক্টোবর ২০২২, ০৯:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

নীরব ঘাতক হাড় ক্ষয়, বেশি ঝুঁকি পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের

দেশে দিন দিন বাড়ছে অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। চিকিৎসকরা বলছেন, আগামী পাঁচ বছরে নন-কমিউনিকেবল যেসব রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হবে তারমধ্যে শীর্ষ পাঁচে উঠে আসবে হাড় ক্ষয় রোগ। বিশেষ করে নারীরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীরা অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হন বেশি। সাধারণত প্রতি তিন নারীর একজন এবং প্রতি পাঁচজন পুরুষের একজন এই রোগে আক্রান্ত হন। তবে বয়স্ক পুরুষদেরও এই রোগ হয়ে থাকে।

এই রোগে আক্রান্তের হার, ঝুঁকি, চিকিৎসা ব্যয় ও প্রতিকার নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, চিকিৎসার চেয়ে রোগটি প্রতিরোধ করাই উত্তম। এ জন্য সুষম খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে ছোটবেলা থেকেই। আর শারীরিক পরিশ্রম ও রোদে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।


বিজ্ঞাপন


তবে এমন সমস্যা বোধ করলে শুরুতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি নিশ্চিত হওয়ার পর উপযুক্ত চিকিৎসা নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন এই বাতরোগ বিশেষজ্ঞ।

হাড় ক্ষয় রোগ কী?

মানুষের জন্মের পর থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হাড় পরিপক্ব হতে থাকে। কখনো আবারও ঘনত্ব কমে হাড় পাতলা হতে শুরু করে। হাড় কমে যাওয়াই হাড় ক্ষয় রোগ। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন ঘনত্ব কতটা কমেছে। সে অনুযায়ী তারা চিকিৎসা দেন।

BSMMUএই রোগে আক্রান্তদের ঝুঁকি আছে। হাড়ের ঘনত্ব কমে হাড় ছিদ্রযুক্ত, দুর্বল এমনকি ভেঙেও যেতে পারে। সঠিক সময়ে এর প্রতিরোধ বা চিকিৎসা না নিলে ব্যক্তিগত জীবনযাপন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। কাউকে আজীবনের জন্য বিছানায় পড়ে যেতে হয়। এ রোগের ফলে আক্রান্তদের কোমর, মেরুদণ্ড ও হাতের কবজির ও কুচকির হাড় সবচেয়ে বেশি ভঙ্গুর হয়ে যায়। আর মেরুদণ্ডের হাড়ের ক্ষয় হলে মানুষ একটা পর্যায়ে গিয়ে কুঁজো হয়ে যায়।


বিজ্ঞাপন


কেন, কখন হয় হাড় ক্ষয়?

মানুষের জীবনের একটা সময় থেকে স্বাভাবিক নিয়মেই হাড় ক্ষয় শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে হরমোনের এক ধরণের প্রভাব থাকে। নারীদের শরীর থেকে হরমোন খুব তাড়াতাড়ি কমে যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে এস্ট্রোজেন এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোনের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে মেয়েদের মাসিক স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার পর এটি বেশি হয়। আর হরমোন কমে গেলে শরীর থেকে দ্রুত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি বের হয়ে যায়। তখন শরীর আর হাড় গঠন করতে পারে না। ফলে শুরু হয় হাড় ক্ষয়।

গবেষণার তথ্য বলছে, ৫০ বছর বয়সে নারী–পুরুষ মিলিয়ে ১৫ শতাংশ এবং ৮০–ঊর্ধ্ব ৭০ শতাংশ মানুষ অস্টিওপোরোসিস রোগে আক্রান্ত হন। এছাড়া যারা ক্যান্সার, রক্তরোগ, অপুষ্টি জনিত রোগ, কিডনি রোগে আক্রান্ত তাদের হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগ ও কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও হাড় ক্ষয়জনিত রোগ হতে পারে।

বাংলাদেশে এই রোগের প্রকোপ কেমন?

গবেষণার তথ্য বলছে, প্রতি তিন নারীর একজন এবং প্রতি পাঁচজন পুরুষের একজন এই রোগে আক্রান্ত হন। সে হিসেবে বাংলাদেশে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে পুরুষ এক কোটি ৪৩ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩ জন আর নারী হলেন এক কোটি ৩৬ লাখ ৫৭ হাজার ৩৮২ জন। এই হিসেবে দেশে হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত পুরুষ ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪০৬ জন এবং নারীর সংখ্যা ৪৫ হাজার ৫২ হাজার ৪৬০ জন।

গবেষণায় বাংলাদেশের এই রোগে আক্রান্তের যে তথ্য উঠে আসছে তা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। ভারতে সার্বিকভাবে হাড় ক্ষয় রোগের প্রকোপ ২০ ভাগ। পুরানো তথ্য অনুযায়ী, চীনে এটি ৫০ শতাংশ।

BSMMU২০৫০ সাল নাগাদ যে পরিমাণ জনসংখ্যা হবে তার মধ্যে এশিয়াতে হাড় ক্ষয় সংক্রান্ত যে কোমরের হাড় ভেঙে যাওয়া তা হবে ৫০ শতাংশ। এই সমস্যাটি শুরুতে চিকিৎসা করা হচ্ছে না। সঠিকভাবে পরীক্ষা করাও হচ্ছে না। হাড় ভেঙে গেলে মানুষ বাঁকা হয়ে যান। বিছানায় পড়ে যান। কুচকির হাড় ভাঙলে সে মানুষ আজীবনের জন্য বিছানাবন্দি হয়ে যান। মেয়েদের বা যাদের এই হাড় ভাঙে তাদের পরবর্তী হাড় ভাঙার সম্ভাবনা ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। কুচকির হাড় ভেঙে গেলে একজন নারীর মৃত্যুর সম্ভাবনা ৫০ভাগ বেড়ে যায়।

হাড় ক্ষয়ের প্রতিকার কী?

এই সমস্যার চিকিৎসার চেয়ে রোগটি প্রতিরোধ করাই উত্তম। কারণ, যদি এই সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে রোগী অন্য রোগেও আক্রান্ত হবে। ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ার পর তার কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়তে পারে। আবার হার্টে সমস্যা শুরু হতে পারে। তখন রোগীর চিকিৎসা ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। তবে এই কষ্টের রোগ থেকে বাঁচতে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার বিকল্প নেই। প্রতিদিন ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, সুষম খাবার যেমন খেতে হবে, তেমনি নিত্যদিন শরীরে রোদ লাগাতে হবে। শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। এসব রোগীদের অন্ধকারে চলাফেরা না করা ভালো। সেই সঙ্গে কোনোভাবেই অতিরিক্ত ওজন বহন করা যাবে না।

সরকারের করণীয় কী আছে?

হাড় ক্ষয় রোগের ব্যাপারে মানুষকে যদি সচেতন করতে না পারি, যথাযথ চিকিৎসা দিতে না পারি তাহলে এই সম্পর্কিত যে খরচ তা আমরা অনেকেই বহন করতে পারব না। এটা সরকারের জন্যও অনেকটা বোঝা হয়ে যাবে। তাই সরকারের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণী মহলের বাত-ব্যথাজনিত বা হাড় ক্ষয়জনিত রোগের চিকিৎসার জন্য সাধারণ মানুষ যাতে সহযোগিতা পায় সেটা ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার তালিকায় উপরের দিকে নিয়ে আসা না যায়, এ জন্য যদি বাজেট বাড়ানো না হয় তাহলে সামনে যে কষ্ট আসবে তা সঠিকভাবে কভার করা যাবে না।

BSMMUউল্লেখ্য, প্রতিবছর ২০ অক্টোবর বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস পালিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এবারও অস্টিওপোরোসিস রোগনির্ণয়, প্রতিরোধ এবং এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন বর্ণাঢ্য আয়োজনে দিবসটি পালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রিউমাটোলজি বিভাগের পক্ষ থেকে এ উপলক্ষে বৈজ্ঞানিক সেমিনারও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বিইউ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর