শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হন সাধারণ বিচারপ্রার্থী’

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ০৮ অক্টোবর ২০২২, ০১:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

‘দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হন সাধারণ বিচারপ্রার্থী’

প্রত্যেকটা পেশাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে টাউট-দালাল প্রকৃতির সিন্ডিকেট। তুলনামূলক ভাবে এই দালালির চক্রটা বিচারাঙ্গনে বেশিই লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের নিরীহ সহজ-সরল মানুষকে ধোকা দিয়ে, মিস গাইড করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তারা। আইনজীবী না, আইনে গ্রাজুয়েশন না থাকার পরেও নিজেকে আইনজীবী দাবি করে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।

এসব অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলাও হয় অনেক। সুপ্রিম কোর্টেও টাউট-দালালদের চিত্র চোখে পড়ার মতো। আর এগুলো নির্মূল করতে কাজ করছে আইনজীবী সমিতি। এই কমিটির অন্যতম সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন আহম্মেদ ভূঁইয়া কাজ করছেন দীর্ঘদিন হলো। তার কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন ঢাকা মেইলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আমিনুল ইসলাম মল্লিক


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল: টাউট বাটপার নির্মূলে কেমন কাজ করছেন?
ফরহাদ উদ্দিন আহম্মেদ ভূঁইয়া: আদালত অঙ্গনে অবাঞ্চিত লোক ভুয়া আইনজীবী সেজে আছে। তাদের দৌরাত্ম্য কিন্তু অনেক বছর যাবত চলে আসছে। এদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেউ কেউ এগিয়ে আসলেও পরবর্তীতে নিজেরা নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়। তো আমি সর্বোচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী হিসেবে এটা ফিল করেছি বিভিন্ন স্তরে। যে টাউট দালাল এবং ব্রোকারদের হাতে যদি নিরীহ বিচারপ্রার্থীরা প্রতারিত হন, তাহলে আমোদের এ পেশার মান মর্যাদা নষ্ট হবে। আইনজীবীদের মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন আসবে। যার জন্য আমার মাথায় একটা চিন্তা আসে, এগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।

এরপর আমরা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদেরকে নিয়ে আমরা একটি কমিটি গঠন করি টাউট-দালাল নির্মূল আন্দোলন গড়ে তুলি ২০১৮ সালে। কমিটি গঠন করার পর থেকে আমরা তৎপরতা চালাই। সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন থেকে আরম্ভ করি। আমরা অভিযান পরিচালনা করি যাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আছে, আমরা তাদেরকে ধরতে পারি। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ট্রেস করে তাদেরকে ধরে আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত কমিটির কাছে এনে উপস্থাপন করি। তারপর সমিতি সব কিছু যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। থানা ও জেল-হাজতে পাঠিয়েছেন। কাউকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন রকমের স্টেপ উনারা নিয়েছেন। কাউকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছেন আইন অঙ্গনে।

ঢাকা মেইল: দালালরা আদালতে কী ধরনের বেশ ধারণ করে আসে?
ফরহাদ উদ্দিন আহম্মেদ ভূঁইয়া: মনও দেখা গিয়েছে যে কালোকোর্ট গাউন পরে ব্যান্ড পরে আদালতে মামলা পরিচালনা করছে, অথচ তারা এসএসসি বা ইন্টামিডিয়েট পাস। তাদের আইনের সনদও নাই, এরকম অনেক লোককে আমরা ধরতে পেরেছি। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই সংখ্যাটা কত এই মুহূর্তে আমি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। এরই ফলশ্রুতিতে সুপ্রিম কোর্টের নতুন কমিটি যখন আসে তখন আইনজীবী সমিতি আমাদেরকে বলল কাজ বেগবান হচ্ছে। এতে করে টাউট-দালাল মুক্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো আমাদের ব্যর্থতা ছিল বিভিন্ন লজিষ্ট্রিক সাপোর্টের কারণে। তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আমাকে তাদের টাউট উচ্ছেদ সাব কমিটি আছে সেই কমিটি কাজ করে। এখানে আমাকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। আমরা মিটিং করে বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নিই। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমরা যখন দুর্বার গতিতে এ ধরনের কাজ করছিলাম তখন আমাদেরই বিজ্ঞ অনেক আইনজীবী যাদের ছত্র-ছায়ায় টাউট বাটপার, যারা ক্লার্ক, মুহুরি নামধারী লোকজন আদালতে বিচরণ করতো। তাদের পক্ষে এসে সিনিয়ররা অবস্থান নিতেন। সেই অবস্থানটা প্রকাশ্যে নিতেন, আমাদের কাছ থেকে টাউটদেরকে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন। এই ধরনের বিষয়গুলো আমাদেরকে কষ্ট দিয়েছে। এক পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায় যে আমরা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির যে সাবকমিটি ছিল আমরা কয়েকজন ছাড়া বাকী সবাই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে আমরা যখন টাউটদেরকে ধরি সুপ্রিম কোর্ট বারে উপস্থাপন করি, কিন্তু কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে দেখি না, তাদেরকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ধরার পর যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় এরপর টাউট উচ্ছেদের কাজ কিছুটা থমকে দাঁড়ায়।

ঢাকা মেইল: তাহলে টাউট-বাটপার উচ্ছেদ কমিটির কোনো কাজ নেই?
ফরহাদ উদ্দিন আহম্মেদ ভূঁইয়া: আছে, অন্যভাবে পরবর্তীতে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে আমরা সারাদেশের আদালত থেকে টাউট উচ্ছেদ এবং টাউট দালাল উচ্ছেদ করার জন্য আমি একটি রিট দায়ের করেছিলাম। আদালত টাউট নির্মূলে আদেশ দেন। বার কাউন্সিলের সচিব, আইনজীবী সমিতি গুলোর সভাপতি সম্পাদক বরাবর এই রিটের আদেশের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদককেও একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে টাউট-বাটপার উচ্ছেদ করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী। কিন্তু তারা এপর‌্যন্ত কোনো কার‌্যকরি ভূমিকা নিয়েছে বলে আমি দেখিনি এবং এটা অত্যান্ত দুঃখজনক। যার কারণে আমি এবং আমার অনেক বিজ্ঞ বন্ধু আছে তাদেরকে নিয়ে আমি গত কিছু দিন আগে একটা মিটিং করেছি। সেই মিটিংয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেরাই আদালত অঙ্গনের টাউট দালাল এবং ভুয়া আইনজীবী মুক্ত করব। সেই ক্ষেত্রে আমরা ফেয়ার প্রাকটিস এন্ড এনট্রি করাপশন মুভমেন্ট নামে একটা সংগঠেনের আত্মপ্রকাশ করেছি। এটা নতুন সংগঠন। এটার কাজ খুব শীঘ্রই আপনারা জানতে পারবেন। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে এর কাজ। এইটার কাজ শুধুমাত্র টাউট উচ্ছেদ থাকবে না। আদালত অঙ্গনে যত প্রকার দুর্নীতি আছে, স্পীড মানি আছে, বকশিশের ব্যাপার আছে সেইগুলো বিষয়ে আমরা কাজ করব।


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল: টাউট বাটপারদের পক্ষে সিনিয়রা অবস্থান নেন কোন যুক্তিতে?
ফরহাদ উদ্দিন আহম্মেদ ভূঁইয়া: তারা বলেন আসলে মামলা-মোকাদ্দমা আসবে ক্লার্কের মাধ্যমেই । টাউটের মাধ্যমেই আসবে। এটা ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে, এটা বহু পুরোনো বিষয়। সিনিয়ররা বলেন, সে আমার চেম্বারে কাজ করে, সে ভালো ছেলে ইত্যাদি। এই ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থন উনারা করতে চান। উনারা অনেক প্রবীণ অনেক সিনিয়র আইনজীবী। যখন আমাদের সামনে এসে এই ধরনের কথা বলেন, তখন আমরা বিব্রতবোধ করি। অনেক নামী সিনিয়রকেও দেখেছি টাউট-বাটপারদের কাজে সমর্থন দিতে। তবে এই সমস্ত টাউট-বাটপার উচ্ছেদের কাজে সবচেয়ে বেশি যিনি ভূমিকা পালন করেছেন তিনি হচ্ছেন বর্তমানে বাংলাদেশের বিজ্ঞ সিনিয়র অ্যাটর্নি জেনারেল সিনিয়র আইনজীবী এএম আমিন উদ্দিন।

উল্লেখ্যে, আইনজীবী হিসেবে সনদ না নিয়ে যারা আইন পেশা করবেন তাদেরকে টাউট হিসেবে উল্লেখ করে সাজা দিতে বিধান রয়েছে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বার কাউন্সিলের।

এআইএম/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর