বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘১৫ আগস্টের আগে নানা গুঞ্জন থাকলেও বঙ্গবন্ধু কর্ণপাত করেননি’

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: ১৫ আগস্ট ২০২২, ০৭:৫৭ এএম

শেয়ার করুন:

‘১৫ আগস্টের আগে নানা গুঞ্জন থাকলেও বঙ্গবন্ধু কর্ণপাত করেননি’
কোলাজ: ঢাকা মেইল

জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কের দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে খুনি চক্র। নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের এক দিন আগেও বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন। সেই সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন ঘনিষ্ঠভাবে। ১৫ আগস্টের আগে-পরের ঘটনা, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর শাসনামলের নানা দিক নিয়ে একান্তে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের নিজস্ব প্রতিবেদক সেলিম আহমেদ।  

ঢাকা মেইল: আপনি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। শেষ সময়ের কথা একটু স্মৃতিচারণ করুন।


বিজ্ঞাপন


ড. ফরাস উদ্দিন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে যাওয়ার জন্য অনেক কষ্ট করে বুঝিয়ে বঙ্গবন্ধুকে রাজি করালাম। ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট আমি তাঁর একান্ত সচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করে রেজাউল হক সাহেবকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিই। তিনি ওইদিন আমার সাবেক কর্মস্থলসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলেন। বঙ্গবন্ধু বললেল, দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিস ঠিক আছে, তবে ১৩ ও ১৪ আগস্ট তুই আমার সঙ্গে থাকবে। ১৪ তারিখ রাতে আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্রে যাবো তাদের ফেয়ারওয়েল ছিল। তবে তিনি ওই অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি। তোফায়েল আহমদকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি গণভবন থেকে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মনোয়ার আর ফরাস দুদিন পরেই চলে যাবে; ছেলে দুটো মায়া লাগিয়ে যাচ্ছে। খারাপ লাগবে খুবই। ভাগ্যিস জামিল এখানেই থাকছে।’ এরপর আমরাও মন খারাপ করে ফেয়ারওয়েল নিয়ে গণভবন থেকে চলে এলাম।

august
১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণকারী বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যরা

ঢাকা মেইল: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর কীভাবে জানলেন?

ড. ফরাস উদ্দিন: ১৫ আগস্ট ভোর ৫টা ৫ বা ৭ মিনিটে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের সেকেন্ড অব কনফিডেন্সিয়াল অফিসার আব্দুল মালেক ভূইয়া ফোন করে বললেন, স্যার! বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কথাটি শুনে বিশ্বাস হয়নি। আমি তাকে উল্টো ধমক দিলাম। তিনি আবার বললেন, না স্যার, ঘটনা সঠিক, তাড়াতাড়ি রেডিও শোনেন। এরপর রেডিও ধরে শুনলাম মেজর ডালিম যা বলার তা বলছে। এরপর রেডিও রেখে ৩২ নাম্বারে ফোন করলাম, কেউ ফোন ধরলেন না। সৈয়দ হোসেন সাহেবের বাসায় ফোন করলাম। শেষমেষ কর্নেল জামিলের বাসায় ফোন করলাম। ভাবি আঞ্জুমান আরা জামিল ফোন ধরে বললেন, ভাই দেখেন না কী শয়তানি করছে। আপনার ভাই বেরিয়েছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।


বিজ্ঞাপন


আমি দৌড়ে বাসা থেকে বের হলাম। কর্নেল জামিল তার লাল রঙের জিপ গাড়িটি নিয়ে চলে গেলেন। চিৎকার দিলাম, থামলেন না। একটা রিকশা নিলাম, যাওয়া শুরু করলাম ৩২ নাম্বারের দিকে। এখন যেখানে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ সেখানে আমাকে থামিয়ে দিল আর্মির লোকেরা। বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন প্রেস সচিব তোয়াব খান, ১৫ আগস্ট লিখেছেন কর্নেল জামিলকে তো হত্যাই করা হয়েছে, ফরাসকে মারধর করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ওই সময় যে রিকশায় ধানমন্ডি ৩২ এর উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিলাম ওই রিকশার ড্রাইভার বলেছিল, আপনি যদি পাগল হন, তাহলে আমি মহাপাগল। আপনাকে ৩২ এ আমি নিয়ে যাবো। এরপর ওই রিকশা ড্রাইভার আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেল, কিন্তু কোনো ভাড়া নিল না। দেখেন সে বঙ্গবন্ধুর কত ভক্ত!

Dr. Mohammed Farashuddin
 বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন

ঢাকা মেইল: ১৫ আগস্টের মতো এমন জঘন্য ট্রাজেডি ঘটতে পারে এমনটা কি আপনারা আগে আঁচ করতে পেরেছিলেন?

ড. ফরাস উদ্দিন: এমন ঘটনা ঘটতে পারে সেই গুঞ্জন ছিল। বঙ্গবন্ধুর ক্যাডারদের একজন লিখিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, মুশতাক আপনার বিরুদ্ধে এই রকম ষড়যন্ত্র করছে। বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, সে তো ১৯৪৮ সাল থেকে আমার বিপক্ষে, কিছুই করতে পারবে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার সমর সেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, আমরা এই বিষয় শুনছি, আপনার যদি কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হয় বলবেন। ১৩ আগস্ট নোয়াখালীতে ভারতীয় হেলিকপ্টার ক্র্যাশ হওয়ার পর গুঞ্জন আরেও পল্লবিত হয়। শোনা যায়, সিআইএ উনাকে ওয়ার্নিং দিয়েছিল, কিন্তু তিনি কর্ণপাত করেননি। তবে আমি বলতে পারি, ১৩ এবং ১৪ আগস্ট আমি উনার সঙ্গে ছিলাম, তখন দেখেছি বঙ্গবন্ধুর চোখ-মুখ লাল। সাধারণত তিনি পায়চারি করতেন, পুকুরের ঘাটে বসতেন, হাত দিয়ে পানিতে আওয়াজ করলে মাছ আসত-কিন্তু ওই দুই দিন তিনি তা করেননি। গুঞ্জন থাকার পরেও তিনি জাতীয়তাবাদী, স্বাধীনচেতা, পালিয়ে যাওয়ার কিংবা কারও কাছ আত্মসমর্পণের লোক ছিলেন না।

ঢাকা মেইল: বাকশাল নিয়ে বিভিন্ন রকমের কথা শোনা যায়- আপনার মতামত কী?

ড. ফরাস উদ্দিন:  বাকশালকে বঙ্গবন্ধু মোটেও একদলীয় শাসন মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, এটা একের মধ্যে বহুর মিলন। তিনি চেয়েছিলেন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূল করতে এবং প্রশাসনকে মানুষের দৌরগোড়ায় নিয়ে যেতে। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, গ্রামে গ্রামে সমবায় করব। উনি চেয়েছিলেন, সমস্ত জমিকে একীভূত করবেন। জমির আইল উঠিয়ে দেবেন। ফসল পাঁচ ভাগ হবে। যে প্রকৃত পক্ষে চাষ করবেন তাকে দুই ভাগ দেওয়া হবে, যে জমির মালিক তাকে এক ভাগ দেওয়া হবে, যার জমি নেই তাকে এক ভাগ আর সরকার এক ভাগ পাবে। আরও ১৫-২০ দিন সময় পেলে এটা সফল হতো। বাকশাল যদি সফল হতো তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালে যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছেন তা ১৯৯০ সালেই হয়ে যেত। বাকশালকে মানুষ যে গালি দেয় এক সময় কিন্তু সেই বাকশালেই আমাদের যেতে হবে। ঢাকায় বসে সারা বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।

bangabandu-1
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু

ঢাকা মেইল: অনেকে বলে বাকশাল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অন্যতম কারণ, আপনি কি তা মনে করেন?

ড. ফরাস উদ্দিন: তাকে হত্যার করার জন্য বাকশাল একটা ছুতা। বিরোধীরা মনে করত, বাকশাল হয়ে গেলে, ফসল পাঁচ ভাগ হয়ে গেলে, প্রশাসন মহকুমা পর্যন্ত চলে গেলে অবশ্যই ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়ে যাবে। তাছাড়া ১৯৭০ এর নির্বাচনে শতকরা ২৮ ভাগ লোক তো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। বাংলাদেশি ছাড়াও পাকিস্তানের পরাজিত শক্তি, আন্তর্জাতিক দুষ্ট শক্তি এবং বঙ্গবন্ধু যেহেতু একবারে স্বাধীনচেতা জাতীয়তাবাদী, কারও কথা শোনেন না-এগুলো তাকে হত্যা করার কারণ।

ঢাকা মেইল: আপনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠভাজন ছিলেন, তাঁর কোন স্মৃতিগুলো আজও আপনাকে নাড়া দেয়।

ড. ফরাস উদ্দিন: তাঁর নানা স্মৃতি আমাকে আজও ব্যাকুল করে তোলে। একটা স্মৃতি বলি, আমি যেদিন তাঁর একান্ত সচিব হিসেবে জয়েনিং করলাম, সেদিনই তিনি লাস্ট বিফ্রিংয়ে বলেছিলেন, দেখরে ফরাস! আমি কিন্তু গরিব দেশের, গরিব চাষাভূষা মানুষের প্রধানমন্ত্রী। আমার কাছে বড় বড় লোকেরা আসবে, তাদের আটকাইলেও কোনো কাজ হবে না। তারা যেকোনোভাবে তাদের কাজ করে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাবা, আমার কাছে যারা গাঁও-গ্রাম থেকে আসবে, যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ আছে, যাদের কাপড় ছেঁড়া-তাদের কাজ কিন্তু তুই করে দিস। আমি যদি নাও থাকি আমার হয়ে কাজটা করে দিস। আমি অনুমোদন করে দিলাম।

Shaeikh-Mujib
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কাটাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু

ঢাকা মেইল: ১৫ আগস্টের পরবর্তী দিনগুলো কেমন ছিল? আপনার ভূমিকা তখন কী ছিল?

ড. ফরাস উদ্দিন: আমিতো বৃত্তি নিয়ে বাইরে পড়তে চলে গেলাম। চার বছর বাইরে ছিলাম আর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ভয়ে বেড়ালাম। আজ পর্যন্ত এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। কোনোদিন বঙ্গবন্ধু ছাড়া কোনো কিছু বলিনি। এমনকি জিয়াউর রহমান সাহেবের সামনেও বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছি।

ঢাকা মেইল: বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের কতটা কাছাকাছি আমরা পৌঁছাতে পেরেছি বলে আপনি মনে করেন?

ড. ফরাস উদ্দিন: আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার পথেই আছি। কিন্তু ’৭৫ সালে দুরভিসন্ধিকারীরা সবকিছু যে উল্টে দিতে চেয়েছিল, এর ফলে আমরা অনেক পিছিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু লাকিলি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় এসেছেন। দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে গেছেন। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে টানা এত বছর ধরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি বিশ্বাস করি, এই পথে এগোতে থাকলে আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার দেখা পাবো।  

এসএএস/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর