শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘সারাজীবন বিনা পারিশ্রমিকে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের ইচ্ছা আমার’

বেলাল হোসেন রাজু
প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০২২, ০৭:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

‘সারাজীবন বিনা পারিশ্রমিকে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের ইচ্ছা আমার’

এক হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপনে ১ টাকাও পারিশ্রমিক নেননি। ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল। সেবাই যার জীবনের ব্রত। বলছি কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম এর কথা। বাংলাদেশের চিকিৎসা অঙ্গনে তিনি এক মানবিক ব্যক্তি। তিনি এরই মধ্যে কোটি বাঙ্গালির হৃদয় জয় করেছেন। 

নামমাত্র মূল্যে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার অসহায় ও গরিব রোগীদের কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন এই চিকিৎসক। করোনা মহামারিতেও পিছপা হননি। বরং আক্রান্ত বহু রোগীকে সেবা দিয়েছেন তিনি। রোগীদের পাশে ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী মতো। নিজের হাতে গড়া সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালে করোনা আতঙ্কের মধ্যেও তিন শতাধিক কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। যা চিকিৎসা জগতে ব্যতিক্রম এক দৃষ্টান্ত। এমনকি সিকেডি হাসপাতালে কিডনি সংযোজনের সাফল্যের হার শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ। এতো ভালো কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২১ এ ভূষিত করেছেন।  

ডা. কামরুল ইসলাম এর শৈশব, বেড়ে ওঠা এবং এমন মহৎ কাজের পেছনের গল্প জানতে সম্প্রতি ঢাকা মেইল তাঁর মুখোমুখি হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট বেলাল হোসেন রাজু
 
ঢাকা মেইল: শৈশব এবং শিক্ষা জীবন নিয়ে জানতে চাই। 
ডা. কামরুল ইসলাম: আমার গ্রামের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদী। বাবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. আমিনুল ইসলাম। প্রথম শ্রেণি থেকেই প্রতিটি ক্লাসে ভালো ছাত্র ছিলাম। সব ক্লাসেই প্রথম হয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিকের পর ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। ঢামেক থেকে স্বর্ণপদকসহ এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করি। তারপর ১৯৯৫ সালে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করি। ২০০০ সালে বিএসএমএমইউ থেকে ইউরোলজিতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করি। তারপর এফআরসিএস পড়তে ইংল্যান্ডে চলে যাই। সেখানে রয়েল কলেজ থেকে এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করি।
 
ঢাকা মেইল: আপনি শিক্ষাজীবনে প্রায় সব শ্রেণীতেই প্রথম হয়েছেন। কর্ম জীবনেও সফল। জানতে চাই, সফল হওয়ার জন্য মেধাই যথেষ্ট?
ডা. কামরুল ইসলাম: প্রথম বিষয় হচ্ছে ভালো রেজাল্টে আস্থা জন্মায়। মনে করেন- পড়লাম, উত্তর দিলাম, একসেপ্টেবল হলো বা স্যার গ্রহণ করলেন, রেজাল্ট ভালো হলো। এতে আস্থা জন্মাবে। ফলে নেক্সট স্টেপে যাওয়া সহজ হয়। যেকোনো কঠিন কাজের চারটি স্তর আছে। যেমন, নিজের ওপর আস্থা থাকতে হবে, ওই বিষয়ের ওপরে শিক্ষা নিতে হবে, এরপরে প্রশিক্ষণ ও পরিশ্রম করে যেতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা লেগে থাকতে হবে। আর এগুলোই সফলতার মূল চাবিকাঠি। 
 
ঢাকা মেইল: জাতীয় কিডনি হাসপাতালের চাকরি কেন ছেড়ে দিয়েছিলেন?
ডা. কামরুল ইসলাম: ২০০৪ সালে ট্রেনিং শেষ করার পর মনে হলো যে ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারবো। ২০০৫ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে জাতীয় কিডনি হাসপাতালে জয়েন করি। ওখানে রোগী রেডি করলাম। কিন্তু স্যাররা বললেন যে তুমি তো এখনও সহকারী অধ্যাপক, তাই তুমি পারবা না, তোমার স্যারদের সহযোগিতা নাও। তখন আমি বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের স্যারদের সহযোগিতায় প্রথম ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছি। ভালোভাবেই শেষ হলো। দ্বিতীয় ট্রান্সপ্ল্যান্ট রেডি করলাম। তো একই কথা। সহকারীদের ট্রান্সপ্ল্যান্ট নিজে করার সুযোগ নেই। তখন চিন্তা করলাম, কবে সহযোগী অধ্যাপক হবো, ততদিন অপেক্ষা করলে তো ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সেই কারণেই কিন্তু প্রাইভেট সেক্টর শুরু করা। তখনও আমি চাকরি ছাড়িনি। প্রাইভেট সেক্টরে ৮/৯টা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার পর আমার ডিরেক্টর স্যার দেখলেন যে, ক্লিনিকেই আমার ৮/৯টা ট্রান্সপ্লান্ট শেষ, এখন আমার সহযোগী অধ্যাপক হতে বাধা নেই। তাই সেই ফিরোজ খান স্যারেরই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে আমি সহযোগী অধ্যাপক হলাম। এভাবে ২০১১ সাল পর্যন্ত কেটে গেছে। কিন্তু প্রফেশনাল কারণে বাধা আসে। আমি ওখানে রোগী রেডি করি, কিন্তু সবার সম্মতি নিয়ে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে। এই সম্মতি নেওয়ার বিষয়টিতে কাজে বাধা চলে আসে। অনেক রিস্ক নিয়ে তবেই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হয়। অথচ স্বাভাবিকভাবে এসব রোগীরা থাকেন খুব অসুস্থ। আর যেসব কিডনি রোগীর অবস্থা শেষ পর্যায়ে, তিনি তো এমনিতেও মারা যান, কিন্তু আমার মেন্টালিটি হচ্ছে, চেষ্টা করতে দোষ কী? চেষ্টা করলে ঠিকই অনেক রোগী সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু দুঃখজনক, ঝুঁকি থাকলেই নাকি অপারেশন করা যাবে না। অথচ এই ঝুঁকিটা নেয়া প্রয়োজন। কারণ, তিনি এমনিতেই মৃত্যুর পথযাত্রী। একটি রোগী ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর জন্য রেডি করতে তার মা-বাবা বা অভিভাবকের কত কষ্ট হয়, সেই রোগীকেই যখন ক্যান্সেল বা না করে দেই, তখন তারা হাতে পায়ে ধরে। বলে যে, প্রাইভেটে হলেও করে দেন। তখন আমার জন্য বিপদ হয়ে যায়, সরকারি হাসপাতালের রোগি কেমন করে প্রাইভেটে নিয়ে কাজ করি।

তাছাড়া সরকারিতে অনেক কাজ করা লাগে, যেগুলো আমার করা মানে অযথা সময় নষ্ট। আমার তো শুধু সার্জারি করে দিলেই হয়। কিন্তু রোগীর সঙ্গে কথা বলা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করতে হয়। প্রতিদিনই সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। যা আসলে সম্ভব হয় না। আমার এখানে আমি লোক তৈরি করেছি। তারা আমার কাজের বাইরের কাজগুলো করে দিচ্ছে। কিন্তু সরকারিতে যে লোক তৈরি করছি, তিনি বেশিদিন থাকেন না। কেননা হুট করে ট্রান্সফার হয়ে যায়। নতুন আরেকজন আসেন। ফলে ট্রান্সপ্ল্যান্টের সংখ্যা বাড়ানো যায় না। প্রতি সপ্তাহে একটা করি, আবার অনেক সপ্তাহে ক্যান্সেল। তাই আমি নিজে উদ্যোগ নিয়েছি। মূলত রোগিদের সেবা দেয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। আমার কাছে এক সময় মনে হয়েছে, ওখানে অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে। তখন চিন্তা করলাম- এই সময়টা নিজের প্রতিষ্ঠানে দিলে ভালো হবে। যদিও প্রথমদিকে সফল হবো কি হবো না, সিউর ছিলাম না। তবে আমার একটা টার্গেট ছিল।  ২০১০ সালে ইন্ডিয়াতে অনেক সেন্টার ছিল, যেখানে প্রতিদিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট হতো। তো আমাদের দেশে কেন হবে না। আমার এই বিষয়ে আস্থা ও আগ্রহ ছিল। ১৬/১৭ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিন একটি করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে না, এটা তো হয় না। ডেইলি না হলেও সপ্তাহে একটি করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে, এমন একটি প্রতিষ্ঠান হোক। এটা তো হওয়া উচিত। এই স্ট্যান্ডার্ড অর্জনের একটি টার্গেট ছিল। সেখান থেকেই এই উদ্যোগ নিলাম।
 
ঢাকা মেইল: সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু সমস্যা আপনার বক্তব্যে উঠে এসেছে, বর্তমানে এসব সমস্যা থেকে কতটা উত্তরণ করতে পেরেছে?
ডা. কামরুল ইসলাম: সরকারি সেক্টরের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। রেট এবং আনুসঙ্গিক বিষয়ে ভারতের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কিন্তু সমস্যা হলো- সরকারি সেক্টরের কাজ অনেক বড় হওয়ায় সমস্যাও জটিল। যেমন, সার্জারি সারাদিন লাগবে। ছয় ঘণ্টা সার্জারির সাথে ছয় ঘণ্টা ফলোআপ জরুরি। কিছু সার্জারিতে তো সময় দরকার ১২ ঘণ্টা। যেমন লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি। এরপর ফলোআপ অত্যান্ত জরুরি। সরকারি হাসপতালগুলোতে অপারেশন হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ডাক্তারদের অতিরিক্ত ডিউটি করতে হয়। এতে চিকিৎসকদের মনোযোগ নষ্ট হয়। সেবার মানও সমুন্নত থাকে না। তাই ২৪ ঘণ্টা সর্জারিয়ানদের টিমওয়াইজ থাকতে হবে। সেই সিস্টেমটা সরকারিতে নেই। এজন্য একটা পরিকল্পিত টিম সেটআপ দরকার। যাতে ফুলটাইম রোগীকে ফলোআপ করা সহজ হয়। চিকিৎকদেরও অতিরিক্ত ডিউটি করতে না হয়। 
 
দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, এখন অনেক করপোরেট হসপিটাল হয়ে গেছে। তাই ডাক্তাররা সেদিকে ঝুঁকছেন। এখন তো প্রশ্ন আসছে, সরকারি সেক্টরেও ডাক্তার কেন থাকতে চান না। কারণ, হুট করে ট্রান্সফার হয়ে যায়। যার কারণে একটা সুন্দর প্ল্যানিং করা যায় না, স্টাফ রেডি করা যায় না। তারাও চেঞ্জ হয়ে যায়। অথচ এটি একটি টিমওয়ার্ক। এখানে সার্জেন্ট একা না। সবাই মিলে সুন্দর একটি টিম যখন গড়ে ওঠে, তখনই ভেঙে যায়, ফলে আউটপুট কমে যায় বা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বরাবরই থেকে যায়। টিমকে ঠিক রাখতে হবে এবং সার্জেন্টরা যেন ওখানেই থাকেন। এরকমই একটি ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। ডাক্তারদের বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে। তা না হলে ডাক্তার চিন্তা করবেন, আমি এখানে সারাদিন কাজ করার চেয়ে করপোরেট যেকোনো হাসপাতালে কাজ করলে এর চেয়ে বেশি রিটার্ন পাবো। তাই সরকারের পক্ষ থেকে সুন্দর পদক্ষেপ নিলেই ভালো। কিন্তু এই ব্যবস্থা কেমনভাবে করা হবে বা আদৌ হবে কি না, তা আমার বোধগম্য নয়। বিষয়টি আসলেই জটিল। কারণ করপোরেট হাসপাতালের কাছাকাছি সিস্টেম করতে হবে। যেভাবেই হোক, যদি সিস্টেমটাকে চেঞ্জ করা যায়, বা সেটা কোনোদিন হয়ে ওঠে, তবে হয়তো সুন্দরভাবে টিমওয়ার্ক করা যাবে, বড় সার্জারিগুলো করাও সম্ভব হবে।
 
ঢাকা মেইল: আপনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২১’ এ ভূষিত হয়েছেন। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
ডা. কামরুল ইসলাম: বাসায় পাঁচটা গোল্ড মেডেল পড়ে আছে। এখন পুরস্কারের দিকে তাকালে মনে হয় যেন ওসবের প্রয়োজন নেই। তখন হয়ত প্রয়োজন ছিল। কারণ, ওসব পুরস্কার আমার পরবর্তী কাজে উৎসাহ জুগিয়েছে। জীবনের শেষবেলা চলে এসেছে। এখন অন্য জগতের চিন্তা করার সময়। তখন মনে হয়েছিল যে, আর মেডেল নেবো না। এক দুইটা মেডেল পরকালের জন্য থাকুক। প্রথমে যখন একুশে পদকের জন্য ডাকা হয়েছিল। আমাকে ডেকেই দেওয়া হয়েছিল তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফরম। তখন ফরমটা নিয়ে বাসায় এসে মনে হলো যে আমি ফরম ফিলআপ করে আর কোনো পদক নেবো না। তাই ফরম আর জমা দেইনি। পরবর্তীতে আমাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় থেকে ফোন করল। এবার আমাকে ফরম ফিলআপ করতে দেওয়া হয়নি। বলেছে সিভিটা জমা দিতে। আমি বললাম, যদি পদকের জন্য সিভি দরকার হয়, তাহলে সিভিটা আলাদা রাখেন। আমি আর কোনো পদক নিতে চাচ্ছি না। আমি সত্যিকার অর্থে চাই যে একটি পদক পরকালের জন্য থাকুক। উনি বললেন যে আমাকে বলা হয়েছে আপনার সিভি কালেক্ট করার জন্য। পরে ডিজি স্যার (ডা. জেনারেল হেলথ) আমাকে ফোন করলেন। আমার অগ্রজ খুরশিদ ভাই উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন, তুই করে ডাকেন। বললেন যে, তুই সিভি পাঠা আমার হোয়াটস অ্যাপে, না হলে তোর হাসপাতাল আমি বন্ধ করে দেবো (দুষ্টুমির ছলে)। আমার কাছে সিভিও ছিল না। কারণ চাকরি করবো না, তাই অনেক দিন সিভি বানাই না। তো আমার সহকর্মী ডা. তাওহিদ বেলাল তপনকে বললাম যে, আমার একটা সিভি বানিয়ে দাও। সেই রাতেই সিভি পাঠিয়ে দিলাম। তারপরে আর কোনো খোঁজ নেইনি। কারণ খোঁজ নিলে আশা জাগতে পারে। পরে যেদিন পদক ঘোষণা করা হবে, তার আগের দিন রাতে আমাকে ফোন করলেন এডিশনাল সেক্রেটারি। তিনি বলেন, আপনাকে তো স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আমি বললাম- যদি মনোনীত করেই থাকেন, তাহলে অবশ্যই আলহামদুলিল্লাহ। আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষকে এতবড় সম্মান দিচ্ছেন, ধন্যবাদ জানাই। আমাকে খুঁজে বের করেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ জানাই। আমার কাজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে পছন্দ করেছেন, সেটাই আমার কাছে পদকের চেয়ে বেশি।

আসলে পদকের ইমপেক্ট তিন জনের উপরে পড়ে। ১) যে পেল ২) যিনি দিলেন ৩) যারা দেখলেন। যে পেলো, সে কিন্তু অলরেডি মটিভেটেড লোক। সাধারণত, মটিভেটেড কোনো ব্যক্তিকে পদক দেন বা না দেন, তার কাজের পার্থক্য খুব একটা হয় না। পারসেন্টিজ হিসাব করলে হয়ত ১০ শতাংশ দায়িত্ববোধ বাড়ে। কিন্তু যিনি দিলেন, আমার মনে হয় তার কৃতিত্ব একটু বেশি। কারণ, তাকে খুঁজে বের করতে হয়। কোনো ভালো মানুষকে দিতে হবে, খুঁজে খুঁজে বের করা লাগে তাকেই। সবচেয়ে বেশি ইমপেক্ট পড়ে। যে দেখলো, সারা বাংলাদেশে কত মানুষ ভালো কাজ করেছে, অনেককেই আমরা চিনি না, জানি না। তারা কিন্তু উৎসাহিত হবেন। তাই তাদের কাজ বেড়ে যাবে। ১০ হাজার ভালো কাজও যদি ডাবল হয়ে যায়, বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে। 
 
ঢাকা মেইল: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
ডা. কামরুল ইসলাম: আসলে কার ভবিষ্যত কোন দিন এটা বুঝা যায় না। তাই আমি কখনও লম্বা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিতে পারি না। যখন যা প্রয়োজন হয়, তা কমপ্লিট করি। অনেকটা এভাবেই সময় কাটছে। ধরেন, রোগীর চাপ অনেকটা বাড়ছে, এটাকে কীভাবে আমরা কোড করতে পারি এটাই এখন দরকার। আমাদের আরও কিছু কাজ আছে, সেগুলো করার চেষ্টা করছি। যেমন ড্রাগ মেজারমেন্ট মেশিন, প্যাশেন্টের রিঅ্যাকশন মাপার যন্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপম্যান্টগুলো নিয়ে আসা ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের আরও বড় পরিসর দরকার, যেন অনেক রোগীকে সার্ভিস দেওয়া যায়। এখন আমরা সপ্তাহে চার দিন কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করছি। সামনে যাতে প্রতিদিন করা যায়, সেভাবে কাজ করে যাচ্ছি। খুব শিগগির ইনশাআল্লাহ পাঁচ দিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু করার পরিকল্পনা আছে।

আমি সবসময় চিন্তা করি যে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ যেন সার্ভিস নিতে পারে। করপোরেট লেভেলের চেয়ে আমাদের রেজাল্টটা যেন ঠিক থাকে, সেদিকে জোর দেওয়ার পক্ষপাতী আমি। একই সঙ্গে খরচটা যেন সহনীয় পর্যায়ের থাকে, সেদিকে আমার নজর সবসময় থাকবে। অনেক টাকা খরচ হওয়ার মতো করপোরেট লেভেল করার চিন্তা-ভাবনা কখনো আমার মধ্যে কাজ করেনি। ইনশাআল্লাহ, একটি ট্রাস্টি হসপিটালের মতো যেন হয়, এরকম একটি চিন্তাভাবনা আছে। আর আমার নিজের আগেরই পরিকল্পনা যে সারাজীবন ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার ইচ্ছা। আমি তো অন্যান্য অপারেশনও করি, সেটাতেই যা আসে, তা দিয়ে হাসপাতালের উন্নতি করি। এটা ওটা কিনি। এটা দিয়ে হয়ে যায়। মুশকিল হচ্ছে টাইম। যদি আমাকে ৫ দিন ৬ দিন কাজ করতে হয়, তাহলে টাইমটা বেশি হয়ে যায়।
 dhaka
ঢাকা মেইল: আপনি জীবনকে কীভাবে দেখেন?
ডা. কামরুল ইসলাম: আমি ছোটবেলা থেকেই ধর্ম মেনে চলার চেষ্টা করি। নামাজ রোজা এসবের দিকে ঝুঁকে পড়ি ক্লাস সেভেন কি এইটে থাকতে। ফলে আমার জীবনে ইসলামের প্রভাবটা একটু বেশি। পরবর্তী জীবনকে (পরকাল) ভালো রাখার চেষ্টা করি। ওই জায়গাটা যেন সেইফ থাকে। আর ওই জায়গাটা সেইফ রাখতে হলে এই জীবনে অনেক কিছুই কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে হয়। আমার উপলব্ধি হলো- আমার জীবনে যতটুকু প্রয়োজন, সেটির মধ্যেই চালাবো। ধরেন, ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবারের প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষুধা নিবারণের জন্য অতি সুন্দর করে দামী খাবার খেতে হবে, এটা তো না। এমনটি আমার মধ্যে কাজ করে না। থাকার প্রয়োজন, কোটি টাকার ফ্ল্যাটে থাকার ইচ্ছা কখনও হয়নি। মোটামুটি থাকা যায়, শোয়া যায়, মোটামুটি আরামের হলেই হয়, অতিরিক্ত কোনো কিছুর দরকার নেই। যেমন যাতায়াতের জন্য আপনার গাড়ির প্রয়োজন। কিন্তু টাকা আছে বলেই কোটি টাকার গাড়িতে চড়তে হবে, এটা কখনওই আমার মধ্যে কাজ করে না। গাড়ি কী জন্য? আনা নেওয়া করবে, একটু নিরাপত্তা দেবে, আরাম দেবে। এই তিনটার জন্য তো অনেক দামী গাড়ির প্রয়োজন হয় না। আমি এখনও সেই পুরাতন গাড়িতেই চড়ি। ওই গাড়িতেই তিনটি বিষয় আছে। ইচ্ছে করলে যে টাকা আছে, তাতে পাজেরো গাড়ি কিনতে পারি। কিন্তু আমি মনে করি, এসব অতিরিক্ত খরচ ছাড়া কিছুই নয়। আমার মনে হয়, টাকার ব্যবহার মানুষের শেখা উচিত। 


বিজ্ঞাপন


আবার অনেকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে বাচ্চা কাচ্চার জন্য জমা করে রাখেন। এসবের আসলে কোনো মানে নেই। বাচ্চার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি উপযোগী হচ্ছে শিক্ষা। তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যত লাগে খরচ করতে হবে, টিচারের পেছনে খরচ করতে হবে। যত বই কেনা লাগে, প্রয়োজনে লাইব্রেরি করে দিতে হবে। বাচ্চা কাচ্চার সঙ্গে মা-বাবাকেও পড়তে হবে। তাতে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একটা ভালো বন্ডেজ তৈরি হয়। এতে আপনার চিন্তা-ভাবনা, চাওয়া অনেককিছুই তাদের মধ্যে সহজে ঢুকতে পারে। আমার মনে হয়, শতকরা নব্বই জনেরও বেশি সফল মানুষ বা প্রতিষ্ঠিত মানুষ কেউ বাপ-মায়ের টাকা পয়সা দিয়ে সফল হয়নি, শিক্ষা থেকে হয়েছে। 

সুতরাং বাচ্চা কাচ্চার জন্য শিক্ষা রেখে যাবেন; অগাধ টাকা পয়সা না। যদি আপনার বেশি টাকা থাকে, সেটা ভালোকাজে ব্যবহার করেন। টাকা বেশি থাকলেই যে অনেক লাক্সারিয়াস জীবন যাপন করতে হবে, এরও কোনো দরকার নেই।

একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর