শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব নেই, এটা সাংবাদিকরা বলেন’

মো. ইলিয়াস
প্রকাশিত: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৭ পিএম

শেয়ার করুন:

‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব নেই, এটা সাংবাদিকরা বলেন’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন, বিএনপির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে ঢাকা মেইলের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। বিএনপির সঙ্গে তাদের মৌলিক কোনো দূরত্ব নেই বলে দাবি করেছেন জামায়াতের এই অন্যতম নীতিনির্ধারক। গণমাধ্যমে দুই দলের দূরত্বের কথা প্রচারের জন্য তিনি দায়ী করেছেন সাংবাদিকদের। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারকে সংস্কারে কিছুটা সময় দেওয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন তিনি। রাজনীতিতে ফেরার আগে আওয়ামী লীগের বিচার জরুরি বলেও মনে করেন তিনি। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা মেইলের নিজস্ব প্রতিবেদক মো. ইলিয়াস

ঢাকা মেইল: ৫ আগস্টের পর জামায়াতের জনপ্রিয়তা অনেকটা বেড়েছে বলে ধারণা করা হয়। এর কারণ কী বলে মনে হয়?


বিজ্ঞাপন


গোলাম পরওয়ার: এখানে জামায়াতের কোনো কৃতিত্ব নেই। এটা আল্লাহ তায়ালার খাস মেহেরবানি। গত ১৫ বছর বলতে গেলে জামায়াত মানুষের কাছে প্রকাশ্যে যেতে পারেনি। প্রকাশ্যে কোনো সভা সমাবেশ, জনসভা করতে পারেনি, সুধী শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের কাছে প্রকাশ্যে আসতে পারেনি। ৫ আগস্টের পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা জনগণ ভোগ করছে। জামায়াতও সেই সুযোগ পেয়েছে। ফলে প্রথম থেকেই জুলাই আগস্টে সকল শহীদের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। বন্যা এলো, সেখানেও আমরা সফর করেছি, যেখানেই গিয়েছি লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছে। একজন শহীদ পরিবারের কাছে গিয়েছি, শেখানেও হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছে। জনসভায় রূপান্তরিত হয়েছে। গ্রামেগঞ্জের তৃণমূলের লোকেরা বেরিয়ে গেছে। তখন আমরা আমাদের দাওয়াতের কথা, সমাজের কথা, ইসলামের বিউটির কথা, কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই সেটা আমরা মানুষের কাছে বলেছি।

৫ আগস্টের পর মানুষ জামায়াত নেতাদের কাছে আসতে পারছে, তাদের চরিত্র দেখতে পাচ্ছে, বক্তব্য শুনতে পাচ্ছে। আমরা যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি সেটা কেমন হবে এই ধারণা মানুষকে এত দিন দিতে পারিনি। এবার আমরা সভা-সমাবেশগুলোতে সেই ধারণা দিতে পারছি। আগে গণমাধ্যমে জামায়াতের কাভারেজ দেওয়া হতো না। এখন গণমাধ্যমগুলোতে ইন্টারভিউ নিচ্ছে, কাভারেজ দিচ্ছে, আমরা কথা বলতে পারছি। মুক্ত গণমাধ্যম মুক্ত নাগরিক অধিকার। এ সুযোগে আমরা আমাদের আদর্শ প্রচার করতে পারছি, নেতাদের সাহচর্য পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফলে জনসাধারণ ইসলামের উদ্দেশ্যকে, লক্ষ্যকে, নেতৃত্বের ওজনকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছে। যে কারণে আমাদের সমাবেশে লক্ষ লক্ষ লোক সমবেত হচ্ছে।

Porwar2

ঢাকা মেইল: যারা জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের দুটি ভাগে বিভক্ত দেখা যাচ্ছে। শহীদ পরিবার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতার চাচ্ছেন আগে হত্যাকাণ্ডের বিচার পরে নির্বাচন। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছেন- সে ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী?


বিজ্ঞাপন


গোলাম পরওয়ার: আমাদের অবস্থান হচ্ছে নির্বাচনের আগে এই মানবতাবিরোধীদের বিচার সম্পন্ন করা। তবে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনও আমরা চাই। নির্বাচন হলেই তো হবে না, নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সেজন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার কিছু সংস্কার প্রয়োজন। এটার সঙ্গে ইলেকশন সিস্টেমের কিছু রিফর্ম লাগবে, পুলিশ এডমিনিস্ট্রেশনের কিছু রিফর্ম লাগবে, জুডিশিয়ারি, সিভিলার, কনস্টিটিউশনের কিছু জায়গায় সংস্কার লাগবে। রাষ্ট্রের সমস্ত জায়গায় সংস্কার না হলেও ছয় সাতটি জায়গায় সংস্কার ছাড়া ইলেকশন ওই ১৪, ১৮, ২৪ এর মতো হয়ে যাবে। সে কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে বলেছি, অন্তত এটুকু সংস্কার করুন। তাতে আপনাদের বেশি সময় লাগবে না। আমরা মনে করি ছয় মাসের মধ্যে এই কাজগুলো করা সম্ভব। এই সংস্কারগুলো শেষে আপনি নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে দিন। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে চলতি বছরে শেষ অথবা আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে যে আইডিয়া দিয়েছেন, তারা যদি এর মধ্যেও শেষ করতে পারেন তাহলেও আমরা আনহ্যাপি হবো না। কারণ আমরা ১৪ বছর অপেক্ষা করতে পেরেছি, এখন দুই চার মাস আগে কিংবা পরে এটা আমাদের কাছে ইম্পোর্টেন্ট নয়। ইম্পর্টেন্ট হলো ইলেকশন নিরপেক্ষ হবে কি না?  নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য যদি দুই-চার মাস আগে পরে হয় এটা কোনো সমস্যা নয়। যৌক্তিক সময় দিতে আমরা রাজি রয়েছি।

ঢাকা মেইল: আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে আপনাদের অবস্থান কী?

গোলাম পরওয়ার: আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষ আর মেনে নেবে না। কারণ তাদের যে খুন, তাদের যে বর্বরতা, এসব বলে শেষ করা যাবে না। ওই আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষ আর মেনে নেবে না। তাদের বিচার হতেই হবে। 

আরও পড়ুন

সত্যিই কি বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়ছে?

ছাত্রদের উত্থান ও জামায়াতের কৌশল কি চ্যালেঞ্জে ফেলবে বিএনপিকে?

ঢাকা মেইল: একাত্তরের মানবতাবিরোধী বিচার নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?

গোলাম পরওয়ার: এটা কোনো বিচার নয়, এটা হচ্ছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক উদ্দেশে করা হয়েছিল। এটা কোনো বিচারই হয়নি।

ঢাকা মেইল: জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলছেন। তাহলে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আইনি কোনো প্রক্রিয়ায় যাবেন?

গেলাম পরওয়ার: আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। আইনি কিছু সংশোধন ছাড়া বিদ্যমান আইনে যা চাচ্ছি তা করা সম্ভব নয়। এজন্য আইনি কিছু সংশোধনের দরকার রয়েছে। তারা একটি সাজানো বানানো আইনের ভিত্তিতে করেছে। এখানে আইনি প্রক্রিয়ার কিছু প্রশ্ন রয়েছে। যে কারণে তারা ইচ্ছে করে বেআইনিভাবে করেছে, কিন্তু তারা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। হাইকোর্ট, আপিল ডিভিশন, রিভিউ, বিচারের সমস্ত স্তর কভার করে তারা এটা করেছে। ফলে সর্বোচ্চ আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে কোনো বিচারের এগেনেস্টে আরেক আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই বিদ্যমান এই ট্রাইব্যুনাল আইনে কোনো আইনি বিধান নেই। এটা করতে গেলে আইন পরিবর্তন করতে হবে। এটা রিট করে আইনকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। সে সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি।

ঢাকা মেইল: বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্বের কারণ কী?

গোলাম পরওয়ার: আমরা বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো দূরত্ব দেখছি না। এটা সাংবাদিকরা বলেন।

ঢাকা মেইল: বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের কারণ কী?

গোলাম পরওয়ার: বক্তব্য তো আমরা সব সময় দিই। আমরা আমাদের মতো কথা বলি, তারা তাদের মতো কথা বলেন। কিন্তু থার্ড ও ফোর (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির) লাইনের নেতারা যা বলেন, এটাকে আমরা বিএনপির বক্তব্য মনে করি না। এটা তার পার্সোনাল বক্তব্য মনে করি। অফিসিয়াল বক্তব্য কোনটা, পার্টির লিডার যদি অফিসিয়াল কোনো কথা বলেন। অফিসিয়াল কনফারেন্সে যদি কোনো দলের নামে কথা বলে, এটা হচ্ছে অফিসিয়াল বক্তব্য। অনেক সময় মিডিয়ার লাইম লাইটে আসার জন্য দলের থার্ড ফোর লাইনের নেতারা এমন বক্তব্য দিয়ে থাকেন। বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে, সালাম-কালাম হচ্ছে। রাজনৈতিক কৌশলগত নির্বাচন এলে এটা থাকবেই। এটাকে দলের সাথে দলের দূরত্ব মনে করি না। এটা গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য।

আল্টিমেটলি বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো রাজনৈতিক দূরত্ব নেই। দল দুটো মত তো দুটো হবেই, একটি প্রতিযোগিতা তো আছেই। সে কারণে যেকোনো দল তার কথা বলবে। এটার জন্য মনে করি গণমাধ্যমে অনেকটা দায়ী। দূরত্ব তৈরি করার পেছনে একটা ইনটেনশন আন্তর্জাতিকভাবেও রয়েছে। কিছু মিডিয়া করপোরেট হাউজে আমরা টের পাই। আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারলে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সুবিধা তারা ভোগ করতে পারবে।

Porwar3

ঢাকা মেইল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে একের পর এক আন্দোলন হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কী বলবেন? 

গোলাম পরওয়ার: আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, ইলেকশনকে দীর্ঘায়িত করা, সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা, অপরাধ জগত তৈরি করা, আওয়ামী লীগকে দেশে আনার জন্যই এই দাবি, সেই দাবি, নৈরাজ্য, সচিবালায় আগুন। এগুলো এতদিন ছিল না। এটা পরিকল্পিতভাবে ঘাঁপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসর এবং আন্তর্জাতিক কিছু এজেন্সির চক্রান্তে হচ্ছে।

আরও পড়ুন

নিষিদ্ধ থেকে রাজনীতির সম্মুখভাগে জামায়াত

মিডিয়ার ফাঁদে জামায়াত-শিবির!

ঢাকা মেইল: আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান?

গোলাম পরওয়ার: খুব ভালো দেখতে চাই একটি কল্যাণ রাষ্ট্র। একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট, একটি ন্যায় ও সুবিচারপূর্ণ দেশ চাই। এখানে মানুষের অধিকার থাকবে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা থাকবে। রাজনৈতিক বিচারিক জীবনে মানুষ স্বস্তি-শান্তি ফিরে পাবে। মানুষের জন্য দুর্ভোগ থাকবে না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে। বাংলাদেশের জামায়াত ইসলামী সেই লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে।

ঢাকা মেইল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

গোলাম পরোয়ার: ঢাকা মেইলকেও ধন্যবাদ।

এমই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর