শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘সব ডাক্তারকে ঢালাওভাবে গালি দেওয়া ঠিক না’

বেলাল হোসেন রাজু
প্রকাশিত: ২৯ মে ২০২২, ১০:৩৩ এএম

শেয়ার করুন:

‘সব ডাক্তারকে ঢালাওভাবে গালি দেওয়া ঠিক না’
অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ (ফাইল ছবি)

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়া উপমহাদেশের অন্যতম মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। এমনকি তিনি গোটা বিশ্বের মেডিকেল অঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম। দেশের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নানা সংকট ও সমাধানে তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি হাজারও শিক্ষার্থীর আইকন।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ চিকিৎসাখাতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৬ সালে একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। করোনাকালে জনসচেতনতার স্বীকৃতি ‘কোভিড হিরো’ পুরস্কার পান। তিনি ‘শর্ট কেইস অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন’ বইয়ের জন্য ২০১৩ সালে ইউজিসি পুরস্কার পান। বাংলা একাডেমি থেকেও তাঁকে অনারি ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহর বেড়ে ওঠা কেমন ছিল, এছাড়া পেশার উন্নয়ন, স্বাস্থ্যখাতে নানা সংকট, মেডিকেল শিক্ষার উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে তিনি ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: বেলাল হোসেন রাজু

ঢাকা মেইল: আপনার শৈশব কেমন ছিল?
ডা. বি এম আব্দুল্লাহ: আমার গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলায় হালিয়াবাড়ি গ্রামে। বলতে পারেন আমি অজপাড়া গাঁয়ের ছেলে। গ্রামের ধুলো মাটিতে আমার  জন্ম এবং সেখানেই মানুষ হয়েছি। আমার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত গ্রামেই কেটেছে। ১৯৫৪ সালে আমার জন্ম। তখন ক্লাসে হাতেগোনা কয়েকজন ছাত্র ছিল। আমি বরারই ক্লাসে প্রথম হতাম। আমার শিক্ষকরা আমাকে স্নেহ করতেন, আদর করতে এবং গাইডলাইন দিতেন। প্রাইমারি স্কুল পাস করে হাইস্কুলে ভর্তি হই। তৎকালীন ইসলামপুর নেকজাহান হাই স্কুলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করি। ওই সময় এটাই ছিল ওই এলাকার একমাত্র হাইস্কুল। সেখানেও মোটামুটি রেজাল্ট ভালো করেছি। সব ক্লাসে ফাস্ট হয়েছি। মেট্রিক পাস করে ঢাকায় আসি। ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাই। সেখান থেকে ১৯৭৮ সালে এমবিবিএস পাস করি। আমি বরাবরই ভালো ছাত্র ছিলাম।  শিক্ষকরা সবসময় আমাকে আদর করতেন। স্কুলজীবন থেকে আমি সবসময় মানুষের জন্য কিছু করতে চাইতাম।

ঢাকা মেইল: আপনার কর্মজীবন ও উচ্চশিক্ষা সর্ম্পকে একটু জানতে চাই?
ডা. বি এম আব্দুল্লাহ: এমবিবিএস পাস করে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগদান করি। এখানেই আমার কর্মজীবনের শুরু। প্রায় চার বছর ঢাকা মেডিকেলে চাকরি করি। সুযোগ আসে বিদেশে যাওয়ার। স্বপ্ন বাস্তবায়নে ১৯৮৯ সালে যুক্তরাজ্যে যাই। রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে ১৯৯২ সালে এই ডিগ্রি অর্জন করি। তারপর দেশে ফিরে ১৯৯২ সালে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মেডিসিন কনসালট্যান্ট হওয়ার সুযোগ পাই। সেখানে দুই বছর কাজ করি। এরপর ১৯৯৫ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে বর্তমানে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। তারপর সহযোগী অধ্যাপক, বিভাগীয় চেয়ারম্যান এবং পরপর তিনবার বিএসএমএমইউতে নির্বাচিত ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০১৮ সালে অবসরে যাই। তারপর ইউজিসি আমাকে তাদের সদস্য করে।

ঢাকা মেইল: আপনি বেশ কিছু বই লিখেছেন এবং আন্তর্জাতিক জার্নালেও আপনার অনেক নিবন্ধন ছাপা হয়েছে। আপনার লেখালেখি নিয়ে একটু জানতে চাই।
ডা. বি এম আব্দুল্লাহ: মেডিকেল শিক্ষার ওপরে এ পর্যন্ত আমি সাতটি বই লিখেছি। এক সময় আমার উপলব্ধি হলো, শিক্ষার কার্যক্রম যদি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারি, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করতে পারি, তবে নিশ্চয় তারা উপকৃত হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই বই লিখি। এখন পর্যন্ত সাতটি বই লিখেছি। এছাড়া পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময় প্রকাশিত লেখা দিয়ে আরও দুটি বই প্রকাশ হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


abdullah2
আমার খুব ভালো লাগে যখন আমি ভাবি, আমার অর্জিত জ্ঞানগুলো আমি দেশের সীমানা পেরিয়ে বাইরেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। আপনারা জেনে খুশি হবেন, বইগুলো দেশের বাইরে বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইতোমধ্যে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ব্রিটেন ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে বইগুলো পঠিত হচ্ছে।
এ পর্যন্ত আমি মেডিসিনের Short case, Long case, Radiology, ECG, Case History এর ওপর বই লিখেছি। আমি চেয়েছি মূলত আমার অর্জিত জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ করে যেতে। আমি যা শিখেছি এবং যা শেখাই তার একটা লিখিত রূপ দিয়ে তা স্থায়ীভাবে আমার উত্তরসূরিদের জন্য রেখে যেতে চাই।

ঢাকা মেইল: সম্প্রতি আপনি প্রফেসর এমেরিটাস হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। কেমন লাগছে?
ডা. বি এম আবদুল্লাহ: বিএসএমএমইউতে আমি প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছি। এটা আমার জন্য খুব সম্মান এবং গর্বের। আমার খুব ভালো লাগছে। বর্তমানে আমি আমার একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

ঢাকা মেইল: আপনাদের সময়কার শিক্ষাব্যবস্থার সাথে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কী ধরনের পার্থক্য খুঁজে পান?
ডা. বি এম আবদুল্লাহ: আমাদের সময়ে তো প্রযুক্তি কিংবা ইন্টারনেট এত ব্যাপক ছিল না। পার্থক্য তো অবশ্যই আছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ওই সময় আমরা তো বেশি কিছু জানতাম না বা জানার সুযোগও ছিল না। কলেজে পড়ার জন্য যখন ঢাকায় এলাম, তখনও এত কিছু ছিল না। গোটা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শাখা-প্রশাখা বেড়েছে। পরিবর্তন এবং পরিমার্জন হয়েছে। এখন গ্রামের বাচ্চারাও মোবাইল, ল্যাপটপ এবং অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় এসেছে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থার যে উন্নয়ন হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ঢাকা মেইল: বিশেষ করে মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে এগোতে পারছি কি?
ডা. বি এম আবদুল্লাহ: নিশ্চয়ই আমরাও সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলছি। পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশেই আমরা তা পারছি। এখন তো ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগ, সবকিছু সহজ। অন্য দেশে শিক্ষা কার্যক্রম কী চলছে কিংবা পরীক্ষা পদ্ধতি কেমন, এসব আমরা খুব সহজেই জানতে পারছি। বলতে পারি উন্নতি অবশ্যই হচ্ছে। পুরোপুরি না হলেও পিছিয়ে আছি একথা বলা ঠিক না। আমার শিক্ষার্থীরা যখন বিদেশে যায়, তারা কিন্তু খুব সুনামের সাথে কাজ করছে। তাই বলতে পারি, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। অবশ্য আরও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে।

ঢাকা মেইল: দেশের স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা শোনা যায়। এ সম্পর্কে কী বলবেন?

ডা. বি এম আব্দুল্লাহ: আসলে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতা কিংবা কেনাকাটায় চুরি এমন সমস্যা সব মন্ত্রণালয়েই আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেহেতু মানুষের জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত, তাই করোনা আসার পর বিষয়গুলো উন্মোচিত হয়েছে। বাস্তবে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতি নেই।
দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে হলে সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা একদিন তো মানুষকে চলে যেতে হবে। অন্যায় অপকর্ম করে পাপের বোঝা বাড়িয়ে তো লাভ নেই।  

abdullah3
আমাদেরকে সর্বস্তরে সবকিছু ঠেলে সাজাতে হবে। প্রশাসনকে যদি দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারি, তবে তো এই দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব না। সবার আগে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। আমি যদি সৎ, দক্ষ, কর্মঠ নিজে না হই, তাহলে কীভাবে অন্যকে বানাবো। তাই সবার আগে নিজেকে তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ যাতে তৈরি হয় সেজন্য প্রশাসনিকব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

ঢাকা মেইল: ওষুধ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময় ডাক্তারদের যে গিফট দেয়, এ বিষয় নিয়ে কিছু বলুন।
ডা. বি এম আব্দুল্লাহ: কোম্পানি প্রতিনিধিদের ডাক্তারের কাছে আসতেই হবে। কোম্পানি একটা নতুন ওষুধ তৈরি করল, কিন্তু ডাক্তারের কাছে এলো না, তাহলে ডাক্তাররা কীভাবে জানবে? পুঁথিগত বিদ্যা আর প্র্যাকটিক্যাল বিদ্যা তো এক না। আর কোম্পানির তো তাদের ওষুধের বিজ্ঞাপন দেবে, সিদ্ধান্ত তো ডাক্তারকে নিতে হবে, তিনি কোন ওষুধটা দেবেন আর কোন ওষুধটা দেবেন না।  তবে কোম্পানিরা ডাক্তারদের টুকটাক গিফট দিলেও প্রচারটা একটু বেশিই করে। আর গিফটের নামে দুই-চারজন ডাক্তার হয়তো ভুল করে, তাই বলে সব ডাক্তারকে ঢালাওভাবে দোষ দেওয়া ঠিক না। তাছাড়া সব পেশাতেই খারাপ ভালো আছে। ডাক্তারা তো ফেরেশতা নয়। সবাই তো একশ ভাগ ভালো না। দুই একজনের অপকর্মের কারণে সবাইকে ভুগতে হবে, বিষয়টা ঠিক না। অথবা মানুষেরা সব ডাক্তারকে ঢালাওভাবে গালি দেয়, তাও কিন্তু ঠিক না।

ঢাকা মেইল: আপনার কাছে জীবনের মানে কী?
ডা. বি এম আব্দুল্লাহ: আল্লাহ তায়ালা জীবন দিয়েছেন, আবার চলেও যেতে হবে। এখানে কিছুদিন পরিভ্রমণ করতে এসেছি। এই জীবন যেন সুন্দর হয়, সার্থক হয়। যতদিন বেঁচে থাকি মানুষের জন্য যেন কিছু করে যেতে পারি। নিজেকে তৈরি করতে পারি, সেটাই আমার লক্ষ্য। সবসময় মানুষকে যেন সেবা দিয়ে যেতে পারি, এটাই আমার ব্রত।

ঢাকা মেইল: তরুণ চিকিৎসকদের উদ্দেশে আপনার বক্তব্য কী?
ডা. বি এম আব্দুল্লাহ: ডাক্তারদের নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। তাই তরুণ চিকিৎসকদের উদ্দেশে একটা কথা বলতে চাই, শুধু চিকিৎসা করলে হবে না, ডাক্তারির সাথে সাথে ভালো মানুষ হতে হবে। ভালো মানুষ না হলে ভালো ডাক্তার হয়েও সমাজে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যাবে না। কাজ করতে হবে সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য। তবেই জনগণ আমাদের সম্মান এবং সহযোগিতা করবে, সেটাই তো আমরা চাই। সাধারণ মানুষ এবং ডাক্তারদের মধ্যে গ্যাপ তৈরি হয়েছে। গ্যাপ দূর করার প্রথম দায়িত্বটা ডাক্তারদের। তাই আমাদের সবাইকে ভালো চিকিৎসক হওয়ার পাশপাশি ভালো মানুষ হতে হবে।

জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর