শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

তাপপ্রবাহ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামনে আরও বড় বিপদ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭ জুন ২০২৩, ০৯:৩৪ পিএম

শেয়ার করুন:

তাপপ্রবাহ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামনে আরও বড় বিপদ
ছবি: সিএনএন

প্রতিদিন অসংখ্যা মোপেড (কম শক্তির হালকা মোটরচালিত সাইকেল) ভিয়েতনামের যানজটপূর্ণ হ্যানয় শহরে চলাচল করে। কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতকারী যাত্রী, মোটরবাইক ট্যাক্সি বা পার্সেল সার্ভিসের সঙ্গে জড়িতসহ অনেকই এটি ব্যবহার করেন।

এদের একজন হলে ফং (৪২)। যাত্রী পরিষেবা অ্যাপের মাধ্যমে সারাদিন গাড়ি চালিয়ে আয় করেন তিনি। প্রতিদিন সকাল ৫টায় তিনি তার শিফট শুরু করেন। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে তিনি দৈনিক ১২ ঘণ্টা মোপেড চালান। কিন্তু প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ (যা গত দুই মাস ধরে চলছে)  ফং এর কাজ আরও কঠিন করে তুলেছে।


বিজ্ঞাপন


দিনে মোটরবাইক চালানোর সময় উত্তাপ থেকে রক্ষা পেতে তিনি একটি টুপি, ভেজা রুমাল ও বেশ কয়েকটি পানির বোতল সঙ্গে রাখেন। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে এগুলো সঙ্গে নেন তিনি। কারণ দিনের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়ে যায়। হ্যানয়ে মে মাসের গড় তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।

তিনি বলেন, যদি আমি হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হই, তাহলে গাড়ি চালানো বাদ দিতে বাধ্য হব। কিন্তু এর বেশি সতর্কতা অবলম্বন করার সাধ্য নেই।

ফং তার বিস্তারিত পরিচয় দিতে অস্বীকার করেন। তিনি রোদের হাত থেকে মোটরবাইকে থাকা মোবাইল বাঁচাতে ছোট ছাতা ব্যবহার করেন। কারণ অ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিংয়ে তাকে মোবাইল এমনভাবে রাখতে হয়। আবার মোবাইলটি নষ্ট হয়ে গেলে তাকে বেশ বিপদে পড়তে হবে। ফং বলেন, আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে একবার সূর্যের সংস্পর্শে আসলে ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে যাবে।


বিজ্ঞাপন


স্যানিটেশন কর্মী দিনহ ভ্যান হাং (৫৩) হ্যানয়ের কেন্দ্রীয় ডং দা জেলার ব্যস্ত রাস্তা থেকে সারাদিন আবর্জনা পরিষ্কার করেন।

দিনহ ভ্যান হাং বলেন, তাপ এড়ানো অসম্ভব, বিশেষ করে দুপুর এবং বিকেলে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা আবর্জনার গন্ধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। কঠোর পরিশ্রম এখন আরও কঠিন। এমন তাপ সরাসরি আমার স্বাস্থ্য এবং শ্রমকে প্রভাবিত করে।

heat wave

এই কাজ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই দিনহ ভ্যানের। তবে তীব্র গরমে কাজের সময়ে কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন। তিনি বলেন, আমি খুব সকালে বা বিকেলে এবং সন্ধ্যায় কাজ করার চেষ্টা করি। লাঞ্চ বিরতির সময় যখন তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে, তখন গলির ফুটপাথে বিশ্রাম নিই। বিকেলে আবার কাজ শুরু করি।

ফং এবং দিনহের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লাখ লাখ ড্রাইভার, রাস্তার বিক্রেতা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নির্মাতা, কৃষক এবং অন্যান্য শ্রমিক বা কর্মী রয়েছেন। এই রেকর্ড তাপপ্রবাহে এসব কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটিকে বিশেষজ্ঞরা এই অঞ্চলের রেকর্ড তাপপ্রবাহ বলে অভিহিত করেছেন।

তাদের মত শ্রমিকরা অনেকটা সমাজের মেরুদণ্ড তৈরি করে। কিন্তু অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চরম আবহাওয়ার প্রভাব তাদের ওপর পড়ছে সবচেয়ে বেশি। বিপজ্জনক উচ্চ তাপমাত্রা তাদের স্বাস্থ্য এবং পেশায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

এপ্রিল এবং মে সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বছরের উষ্ণতম মাস। কারণ মৌসুমি বৃষ্টিপাতের আগে এই সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পর্যটনের হটস্পট থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামসহ এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ আগে কখনও এমন ব্যাপক তাপপ্রবাহ দেখেনি।

থাইল্যান্ড গত ১৫ এপ্রিল ৪৫.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখেছিল। এটি দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম দিন। পাশের দেশ লাওস মে মাসে টানা দুই দিন ৪৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখেছে। ভিয়েতনাম মে মাসের শুরুতে ৪৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখেছে। এটি দেশটির সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। আবহাওয়াবিদ ম্যাক্সিমিলিয়ানো হেরেরা আবহাওয়া স্টেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য দিয়েছেন।

হেরেরা এটিকে 'সবচেয়ে নৃশংস কখনও শেষ না হওয়া তাপ তরঙ্গ' হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এটি জুন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশনের (ডব্লিউডাব্লিউএ) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে, বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক জোট বলেছে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এপ্রিলের তাপপ্রবাহ ছিল ২০০ বছরের মধ্যে একটি ঘটনা, যা মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়া 'কার্যত অসম্ভব'।

সমাজের প্রান্তিক সদস্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং গরম মোকাবেলায় যাদের পর্যাপ্ত সামর্থ নেই এবং যারা অত্যন্ত গরম ও আর্দ্র পরিবেশের সংস্পর্শে রয়েছে এমন লোকদের তাপপ্রবাহের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

জলবায়ু পরিবর্তন এটিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে
চরম তাপমাত্রায় বাতাসের আর্দ্রতা শরীরকে ঠান্ডা করা আরও কঠিন করে তুলেছে। তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতা, যেমন হিটস্ট্রোক, ক্লান্তি বাড়তে পারে। বিশেষ করে যাদের হৃদরোগ এবং কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস রয়েছে এবং যারা গর্ভবতী তাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনে বিশ্ব আবহাওয়া অ্যাট্রিবিউশন উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য চরম ঘটনাগুলোর প্রায়-রিয়েল টাইম অ্যাট্রিবিউশনের গবেষণা সহযোগী মরিয়ম জাকারিয়া বলেন, যখন আশেপাশের আর্দ্রতা খুব বেশি থাকে, তখন শরীর নিজেকে ঠান্ডা করার জন্য আর্দ্রতা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ঘামতে থাকবে। কিন্তু ঘাম বাষ্পীভূত না হওয়ার কারণে এটি অবশেষে গুরুতর ডিহাইড্রেশনের দিকে পরিচালিত করে এবং তীব্র ক্ষেত্রে এটি হিটস্ট্রোক এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

heat wave

তিনি বলেন, এ কারণেই একটি আর্দ্র তাপ তরঙ্গ শুকনো তাপ তরঙ্গের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।

কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস ডেটার সিএনএন বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের শেষের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মহাদেশীয় অংশের সবগুলো দেশই প্রতি একক দিনে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা তার বেশি তাপমাত্রায় পৌঁছেছে। এটি বিপজ্জনক। বিশেষত যাদের স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে বা যারা চরম গরমে অভ্যস্ত নয় তাদের জন্য।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন রিপোর্ট অনুসারে, এপ্রিল-মে তাপপ্রবাহের কারণে হাসপাতালে রোগী বেড়ে গেছে। রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আগুন ছড়িয়েছে এবং স্কুল বন্ধের কারণ হয়েছে। তবে তীব্র গরমের কারণে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেটি অজানা।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই ডিগ্রি বেশি ছিল। যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত বাড়তে থাকে, তবে এই ধরনের আর্দ্র তাপ তরঙ্গ দশগুণ বেশি ঘন ঘন ঘটতে পারে।

জাতিসংঘের হিউম্যান ক্লাইমেট হরাইজনস অনুমান অনুসারে, যদি নির্গমন একই গতিতে বাড়তে থাকে, তবে এই অঞ্চলের দেশগুলোতে তাপজনিত মৃত্যু কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

চরম তাপমাত্রার বেশি শিকার দরিদ্ররা

চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো পদ্ধতিগত অসমতাও প্রকাশ করে। ডব্লিউডাব্লিউএ রিপোর্টের অন্যতম লেখক এবং থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রভাষক ছায়া বধনফুটি বলেন, পেশা, বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং অক্ষমতা, স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলোতে অ্যাক্সেস, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, এমনকি লিঙ্গ- এই সমস্ত কারণ যা মানুষকে তাপপ্রবাহের জন্য কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।  

সমাজের প্রান্তিক সদস্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং গরম মোকাবেলায় যাদের পর্যাপ্ত সামর্থ নেই এবং যারা অত্যন্ত গরম ও আর্দ্র পরিবেশের সংস্পর্শে রয়েছে এমন লোকদের তাপপ্রবাহের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

heat wave asia

কোপেনহেগেন সেন্টার ফর ডিজাস্টার রিসার্চের একজন লেখক এবং পরিচালকও মে মাসে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, কে মোকাবেলা করতে পারে এবং কার কাছে কী সংস্থান রয়েছে সে সম্পর্কে কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ। যারা শ্রমিক তাদের কাছে একদিন কাজ বন্ধ মানে একদিনের আয় নেই।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুসারে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৬০% এরও বেশি কর্মরত জনসংখ্যা অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে কাজ করে। কম্বোডিয়া এবং মায়ানমারে এই সংখ্যা ৮০% এরও বেশি।

এপ্রিলের শেষের দিকে থাই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ রাজধানী ব্যাংকক এবং সারাদেশে চরম তাপ সতর্কতা জারি করে। লোকজনকে বাড়ির ভিতরে থাকতে এবং হিট স্ট্রোকের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে। কিন্তু সাধারণ অনেক মানুষ আছেন যাদের কাজের জন্য বাড়ি থেকে বেরনো বাধ্যতামূলক।

২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাইরে কাজ করে এমন কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে।  তারা ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকিতে দুই থেকে তিনগুণ বেশি থাকে, যার ফলে কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস এবং অন্যান্য সম্পর্কিত অসুস্থতার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন বিজ্ঞানীরা এসব দেশের সরকাররে তাপরোধে ব্যবস্থা নেওয়া, সতর্কতা ব্যবস্থা, সঠিক নগর পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়েছে।

তারা বলেছে, কোনো দেশের একার পক্ষে এই তাপ মোকাবেলা করা এবং চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক পদ্ধতি ছাড়া ও জলবায়ু সংকট মোকাবেলা না করতে পারলে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

এই অঞ্চলে সাধারণত মে মাসে বৃষ্টি আসে। কিন্তু জুন মাসের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সেটি সেইভাবে দেখা যায়নি।

সূত্র: সিএনএন

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর