পবিত্র মাস রমজান। মুসলিমদের কাছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বছরের সবচেয়ে সেরা সময় এটি। প্রতিটি দেশেই রমজান মাস নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে আলাদা সংস্কৃতি। তবে সবার উদ্দেশ্য এক তা হলো- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও পবিত্র মাসের তাৎপর্য মেনে চলা। ইসলামের তৃতীয় পবিত্র নগরী ও প্রথম কেবলার অবস্থান ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে। মসজিদুল আকসায় রমজানে জড়ো হন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। নিজ ভূখণ্ডে পরাধীনতার শৃঙ্খল পরা ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব সংস্কৃতিতে স্বাগত জানান রমজানকে।
ইসরাইলি নির্যাতন-নিপিড়নে মধ্যে থাকা ফিলিস্তিনি মুসলিমরা সারা বিশ্বের মুসলমানদের সঙ্গে পবিত্র রমজান মাসের রোজা পালন করছে। তাদের মুক্তি সংগ্রামের একটি প্রয়াসও পবিত্র রমজান মাস।
বিজ্ঞাপন
তৃতীয় পবিত্র নগরী ও প্রথম কেবলা
বহু নবী-রাসূলের জন্মস্থান এই ফিলিস্তিন। এর মাটিতে পা রেখে চলেছেন হাজারো অলি-আওলিয়ারা। ফিলিস্তিনের বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ থেকে রাসূল (সা.) মেরাজে গমন করেন। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমের সূরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদের হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। ’
ইসরাইলি নির্যাতনের মুখেও নিজস্ব স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন হারায়নি ফিলিস্তিনিরা। তাদের সেই স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আল আকসা মসজিদ এবং ডোম অব রক (কুব্বাতুল সাখরা)। তবে এখানে ফিলিস্তিনিরা ইচ্ছা করলেই আসতে পারে না দখলদার ইসরাইলিদের বিধিনিষেধের কারণে। তবুও আল আকসা মসজিদের প্রতি তাদের ভালোবাসার কমতি নেই। রমজান এলে তাদের সেই ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়।
সুখে-দুখে মিলেমিশে থাকার প্রত্যয়
প্রতিবেশির খোঁজ-খবর নেওয়া এবং মুসলমানের সাহায্যে নিজের সর্বোচ্চ বিলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টান্ত মেলা ভার। রমজানে তাদের এই প্রচেষ্টা শতগুণে বেড়ে যায়। অনেকেই সারা মাস মেহমানকে সঙ্গে নিয়ে ইফতার করেন। প্রত্যেক ফিলিস্তিনি প্রতিবেশীর প্রতি সর্বোচ্চ নজর রাখেন যাতে করে কেউ খাবারের কষ্ট না পায়। সম্মিলিতভাবে নেয়া হয় সহায়তা প্রকল্প।
বিজ্ঞাপন
সেহরির সময়ে জান্নাতি পাখিদের ডাক
রমজানের মধ্যরাতে জেরুজালেমে ছেলেমেয়েরা মিলে ড্রাম বাজিয়ে এবং চিৎকার করে ঘুম থেকে মানুষকে সেহেরি খেতে জাগায়। এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। প্রযুক্তিগত বহু উন্নতি হলেও এটি একটি সম্মানিত ঐতিহ্য যা আজও অব্যাহত রয়েছে। সেহরির সময়ে দলবেধে এমন মধূর চিৎকারে মনে হয় যেন জান্নাতি পাখিরা ডাকছেন। মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এই প্রথা এখনো চালু রয়েছে।
বিশেষ বিশেষ খাবার
ফিলিস্তিনিদের রমজানের রান্নায় অনেক খাবার রয়েছে, যার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে অন্যদের তুলনায় বিশেষ ধরনের পদ পছন্দ করা হয়। গাজায় সাধারণত মাকলুবা, সুমাগিয়াহ এবং মাফতউল খায়। পশ্চিম তীরে মুসাখান ও মনসাফ বিখ্যাত। আচার এবং সালাদ সবসময় ফিলিস্তিনি ইফতারের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
ইফতার-সেহরি যেন থাকে সবার ঘরে
জেরুজালেমের বাসিন্দারা চিরায়ত ঐতিহ্য অনুযায়ী তাদের জনপ্রিয় পানীয় তামারিন জুস পান করেন। তবে সাধারণত তারা ইফতার প্রথমে খেজুর দিয়ে শুরু হয়। পনির ও দই জাতীয় খাবার ইত্যাদি সেহরিতে খায়। ফিলিস্তিনিরা খুব ঘটা করে এবং আনন্দের সাথে ঈদ উদযাপন করে থাকে।
জেরুজালেমে রমজানের কামান ছুঁড়ে ও আতশবাজি ফুটিয়ে ইফতারের সময় জানানো হয়। জেরুজালেমের বাসিন্দারা শত শত বছর ধরে রমজানের সময় কামানের গোলাগুলি শুনেছেন। জেরুজালেমের কামানটি শহরের মাঝখানে সালাহ আল-দিন রাস্তায় আল-সাহিরা গেট এলাকায় মুজাহিদিন ইসলামিক কবরস্থানে অবস্থিত। অন্যান্য শহর, যেমন কলকিল্যা, মসজিদে জামুর ইফতার (রোজার সাইরেন) ব্যবহার করে রোজা ভাঙার জন্য অবহিত করে।
অবরুদ্ধ গাজায় রমজান
দিনের বেলায় গাজাবাসী তাদের সময় কাটায় খাবার তৈরি করে, পবিত্র কোরআন পাঠ করে, প্রার্থনা করে এবং রমজানের বিশেষ সোপ অপেরা এবং কমেডি শো দেখে। ইফতারের সময় পরিবারের সবাই বড় টেবিলের চারপাশে একত্রিত হয়। লোকেরা সাধারণত খেজুর খেয়ে, তারপরে পানি পান করে এবং 'লিসান অ্যালাসফোর' স্যুপ খেয়ে তাদের রোজা ভঙ্গ করে।
রমজানের ঐতিহ্য লণ্ঠন
মাহে রমজান আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা লণ্ঠন ক্রয় করে এবং সেই লণ্ঠন জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেন। এই ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে এবং দেশটির বিভিন্ন শহর বিশেষ করে জেরুজালেমের প্রাচীন অংশ জাকজমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এই লণ্ঠনগুলি বিভিন্ন আয়তন এবং আকারে প্রস্তুত করা হয় এবং পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং আকর্ষণীয় রঙে সাজানো হয়।
রমজানেও থামে না ইসরাইলি অত্যাচার
প্রতিবছর রমজান মাস আসলে অন্য সময়ের চেয়ে অনেকটা বেড়ে যায় ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরতা। প্রতিবছরের মতো এই বছরেও এরই মধ্যে তার প্রমাণ মিলেছে। শুক্রবার হেবরনে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত একজন নিহত এবং বহু ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। একই দিনে অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। শুক্রবারভূমি দিবসের ৪৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভে গুলি ছোঁড়ে ইসরাইল।
আল্লাহ বলেছেন, 'রোজা আমার জন্য আর এর প্রতিদান আমিই দিবো'। এজন্য মুসলিমরা পবিত্র মাসে নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন আর পানাহ চান একমাত্র প্রভুর কাছে। ফিলিস্তিনিরা মহান প্রভুর কাছে চান তাদের বিজয়।
সূত্র: আল জাজিরা, প্যালেস্টাইন ক্রনিকল, ডেইলি নিউজ ইজিপ্ট, ইয়েস প্রোগ্রামস।
একে

