সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইমরান খানের উত্থান-পতনের গল্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ মে ২০২৩, ০২:১৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ইমরান খানের উত্থান-পতনের গল্প
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।- ফাইল ফটো

পাকিস্তানি ক্রীড়াদুনিয়ায় তিনি বিশ্ববরেণ্য নায়ক। ১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তার অধিনায়কত্বে সেই তোলপাড় ফেলা বিশ্বকাপ জয় পাকিস্তানের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় সাফল্য। তার উপস্থিতিটাই একটা অন্য মাত্রা যোগ করে। ইমরান খান। আজও, পাকিস্তানিদের কাছে তিনি ‘কাপ্তান সাহেব’। মঙ্গলবার তার আচমকা গ্রেফতারির খবরে কার্যত উত্তাল পাকিস্তান। ইসলামাবাদ জুড়ে জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা।

ইমরান খানের জীবনটাই এক রোমাঞ্চকর গল্প। লাহোরের এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের সন্তান। স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটেছে ছোটবেলা। পড়াশোনা করেছেন লাহোরের শতাব্দীপ্রাচীন অ্যাচিসন কলেজে। তারপর পাড়ি দেন ব্রিটেনে। ভর্তি হন অক্সফোর্ডে। ১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ডের কিবল কলেজ থেকে দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হন।


বিজ্ঞাপন


অক্সফোর্ডে পড়তে পড়তেই ক্রিকেটার ইমরান খান চলে আসেন প্রচারের আলোয়। অক্সফোর্ডের ক্রিকেট দলে খেলেছেন নিয়মিত। তারপর যোগ দেন সাসেক্সে। তারপর বিভিন্ন নারী কীর্তির জন্য তিনি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন।

শোনা যায়, প্রায় একইসময় অক্সফোর্ডে পড়তেন বেনজির ভুট্টো। তার সঙ্গেও সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ইমরানের এক জীবনীকার। যদিও ইমরান বলেছেন, তারা কেবলই ভাল বন্ধু। নাম জড়িয়েছিল বলিউড অভিনেত্রী জিনাত আমান, রেখার সঙ্গেও।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ইমরানের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক আজকের নয়। ইমরান যখন বিশ্বকাপ জেতেন, তখন তার বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই। ঠিক তার আগের অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক ছিল ভারত ও পাকিস্তান। সেমিফাইনালে পাকিস্তান খেলেছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে, আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ছিল ভারত।

সারা পৃথিবী অপেক্ষা করে ছিল বিশ্বকাপ ফাইনালের, ভারত বনাম পাকিস্তান! ফাইনাল হয়েছিল কলকাতায়। স্রেফ এই আন্দাজেই উল্কার বেগে উড়ে গিয়েছিল সব টিকিট। কিন্তু লাহোরে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয় পাকিস্তান। আর মুম্বাইতে ভারতকে হারায় মাইক গ্যাটিং-এর নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড। ইডেনে ফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড!


বিজ্ঞাপন


ইমরান সেবারেই অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। শোনা যায়, এরপর তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন পাকিস্তানের সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া উল হক। ইমরান রাজি হন পরের বিশ্বকাপের জন্য। পরের ঘটনা ইতিহাস।

বিশ্বকাপ জিতেই শেষ অবধি অবসর নেন ইমরান। শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের দল— পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফ (পিটিআই)। তবে তার চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা রাজনীতিতে শুরুতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। পিটিআই সেরকম জনপ্রিয়তার ধারপাশ দিয়েও যায়নি শুরুতে। পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজ, উন্নত আধুনিক শিক্ষার আলোর বাইরে থাকা গ্রামীণ জনতার একাংশ ইমরানের মত অতি-আধুনিক, বিলিতি আদবকায়দায় অভ্যস্ত কাউকে নেতা হিসেবে ভাবতেই পারেনি। তবে ধীরে ধীরে কৌশলী হয়ে সেই অবস্থার উন্নতি ঘটনা ইমরান খান।

১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরিফকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশারফ। তারপরের আট বছর পাকিস্তানে স্থিতাবস্থা ছিল। বলা হয়, মুশারফ জামানাতেই পাকিস্তানের ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’ বা জাতীয় পরিষদ প্রথম তার পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে। তার আগে একবারের জন্যও সভা মেয়াদ শেষ করতে পারেনি, কোনও না কোনওভাবে সরকারের পতন হয়েছে। ২০০৮ সালে শেষ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা করে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন।

তখন পাকিস্তানে ক্ষমতার শীর্ষে উত্থান চলছে ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ বা পিপিপির। দেশে ফিরে এসেছেন বেনজির ভুট্টো। ২০০৭ এর অক্টোবরে করাচিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে, এবার নিশ্চিতভাবেই প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে চলেছেন তিনি। নওয়াজ শরিফ তখনও সৌদি আরবে। অথচ মাত্র দু’মাসের মধ্যে ঘটে গেল নক্ষত্রপতন। ২৭ ডিসেম্বর সকালে হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বেনজির। সেদিন বিকেলেই বুলেটপ্রুফ গাড়ির বাইরে বেরোতেই রাওয়ালপিণ্ডি কেঁপে উঠল বিস্ফোরণে। হত্যা করা হয় বেনজির ভুট্টোকে।

সেবারের নির্বাচন জিতেছিল পিপিপি। কিন্তু আসিফ আলি জারদারির পক্ষেও মেয়াদ পুরো করা সম্ভব হয়নি। ২০১০ থেকে আবার ইমরানের কপাল খুলতে শুরু করে। চূড়ান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে পিপিপি প্রধান জারদারির বিরুদ্ধে। পাশাপাশি পাকিস্তানে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা।

২০১৩ সাধারণ নির্বাচনে ১৬৬টি আসন জিতে এবং কিছু নির্দলের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠাতায় সরকার গঠন করে নওয়াজ শরিফ। ততদিনে পাকিস্তানের উত্তরে রুক্ষ, শুকনো, হিন্দুকুশ-সুলেইমানের পাহাড়ি প্রান্তরে ছড়ানো খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে প্রাদেশিক সরকার গড়েছেন ইমরান।

নওয়াজ শরিফের রাজত্বও স্থায়ী হয়নি। ২০১৬ সালে পানাম পেপার কেলেঙ্কারিতেই নওয়াজের গদি উল্টে যায়। আদালতের রায়ে তাকে নির্বাসিত করা হয়, কারাদণ্ডের আদেশও দেওয়া হয়। ২০১৮ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে ইমরানের পিটিআই দল।

অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান। শুরু করেছিলেন তার ‘প্রথম একশো দিনের লক্ষ্যমাত্রা’। নজরে ছিল চাষিদের ভর্তুকি দেওয়া, ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো, উৎপাদনে বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ, পাকিস্তানি রুপির বিনিময় মূল্য কমানো। বিশেষ করে আর্থিক সংস্কারে ইমরান কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন দেশের কর ব্যবস্থার সংস্কার করে অভিজাতদের প্রদেয় করের হার বাড়াতে। 

দক্ষিণ পাঞ্জাবে সরাইকিস্তান বলে মুলতানিভাষি সরাইকি জাতির জন্য আলাদা প্রদেশের ভাবনাও ছিল তার। লাহোরের ছেলে ইমরান করাচিকে ঢেলে সাজাতেও পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি আগে থেকে থাকা সংকটের কারণে তেমন কিছুই করতে পারেননি তিনি। ২০২২ সালে আস্থাভোটে হেরে বিদায় নিতে হয় তাকে।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে নিরপেক্ষ ও অগ্রীম সাধারণ নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে আসছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে শতাধিক দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সূত্র: ‌দ্য ওয়াল

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর