শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হিন্দু সন্তানদের মুসলিম বাবা-মা, সিনেমাকেও হার মানায় যে কাহিনি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:০৪ পিএম

শেয়ার করুন:

হিন্দু সন্তানদের মুসলিম বাবা-মা, সিনেমাকেও হার মানায় যে কাহিনি
সেই ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা

৫০ বছর আগের কথা। ভারতের কেরালার মলপ্পুরম জেলার কালিকাভুর বাসিন্দা আব্দুল আজিজ হাজি এবং থেন্নাদন সুবাইদা। ধর্মপ্রাণ এই মুসলিম দম্পতি এবং তাদের তিন সন্তানের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে দক্ষিণী সিনেমা ‘এন্নু সান্থাম শ্রীধরন’। ৯ জানুয়ারি কেরালায় মুক্তি পাওয়া এই ছবি দেখে আবেগে ভাসছেন দর্শক। 

উচ্ছ্বসিত হয়ে টুইট করেছেন কংগ্রেস এমপি শশী থারুর। তবে অনেকে বলছেন ছবির চেয়েও ‘নাটকীয়’ এই দম্পতির কাহিনি।


বিজ্ঞাপন


ধর্মপ্রাণ মুসলিম দম্পতি কোলে তুলে নিয়েছিলেন হিন্দু পরিচারিকার তিন সন্তানকে। সন্তানস্নেহে তাদের মানুষ করেছেন। তবে কাজটা সহজ ছিল না। সামাজিক গোঁড়ামি, চোখরাঙানি উপেক্ষা করেছেন ওই দম্পতি। পালিত তিন সন্তানের বাবা-মা হয়েছেন তারা। কিন্তু ধর্মান্তরিত করেননি তাদের। মুসলিম বাবা-মায়ের তিন হিন্দু সন্তানকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘এন্নু সান্থাম শ্রীধরন’ ছবির গল্প।

পরিচারিকা হলেও চাক্কি ছিলেন সুবাইদার পরিবারেরই এক জন। চাক্কির মৃত্যুর হয় আচমকা। তার তিন সন্তান শ্রীধরন, রমানি এবং লীলাকে তার নিজের তিন সন্তানের সঙ্গে বড় করেন সুবাইদা।

২০১৯ সালের জুলাই মাসে কিডনির অসুখে মৃত্যু হয় সুবাইদার। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বছর দুই বেঁচে ছিলেন আজিজ হাজি। ২০২১ সালে মৃত্যু হয় তার।

২০১৯ সালেই প্রথম সামনে আসে মুসলিম সুবাইদা ও তার হিন্দু সন্তানদের কাহিনি। একটি ফেসবুক পোস্টে ‘হিন্দু’ শ্রীধরন নিজের ‘উম্মা’র (মালয়ালমে মুসলিম মা) কথা লেখায় সামনে আসে ওই মহিলার গল্প। কীভাবে হিন্দুর মা ‘উম্মা’ হলেন, পড়তে পড়তে চোখ ভিজে যায় নেটিজেনদের।


বিজ্ঞাপন


প্রথমে অনেকেই একে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা মনগড়া গল্প বলে মনে করেছিলেন। কেউ কেউ লিখেছিলেন, ‘কেন এসব গল্প লেখেন?’ পরে জানা যায়, ওমানে আটকে থাকা ছেলে তার ‘উম্মা’কে শেষবারের মতো দেখতে না পেয়ে এই পোস্টটি করেন। ক্রমশ তা ভাইরাল হয়। সেই কাহিনি নিয়ে তৈরি হয় সিনেমা।

সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউজ মিনিট’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শ্রীধরন বলেন, ‘উম্মা (মা) এবং উপ্পা (বাবা) এর নিজেদের তিন সন্তান আছে। আমরা উম্মার বাড়িতে জায়গা পাওয়ার পর ওদের আরও এক সন্তান হল। আমাদের বোন জোশিনা। কিন্তু ওই বাড়িতে আমরা তিন ভাইবোন কখনও নিজেদের অবাঞ্ছিত বলে মনে করিনি। কখনও উম্মা-উপ্পা আমাদের বুঝতেই দেননি, কে তাদের নিজেদের সন্তান আর কে সৎ।’

শ্রীধরন জানান, নিজের বাড়ি বলতে তিনি উম্মার বাড়িই বোঝেন। নিজের নিরাপদ আশ্রয় মানে জানতেন উম্মার কোল। তার কথায়, ‘উম্মার নিজের সন্তান জাফর। ভাই আর আমাকে একসঙ্গে স্তন্যপান করিয়েছেন উম্মা।’

সেই মায়ের চলে যাওয়ার দিনে তার কাছে থাকতে পারেননি শ্রীধরন। ছটফট করেছেন বিদেশে। কেঁদেছেন একা একা। সবাইকে জানাতে চেয়েছিলেন তার উম্মার কথা। তাই সে দিন ফেসবুকে লিখে ফেলেছিলেন কীভাবে হিন্দুর সন্তান হয়ে মুসলমান বাবা-মায়ের কাছে লালিত-পালিত হয়েছেন। বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন।

তবে ওই পোস্টের পর অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন। শ্রীধরনের কথায়, ‘যখন আমি আমার তাকিয়া পরা ছবি পোস্ট করতাম, তখনও অনেকে প্রশ্ন করতেন কী ভাবে শ্রীধরন নামের কোনও ছেলে মুসলমানের পোশাক পরেন!’

জন্মদাত্রী মা যখন মারা যান, শ্রীধরনের বয়স তখন এক বছর। দুই বোন ছিল। বাবাও ছিলেন। তবে যেদিন তার নিজের মা মারা গেলেন, সে দিনই উম্মা আর উপ্পা তিন কচিকাঁচাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিজের সন্তানদের মতো এই তিন খুদেকেও বড় করেছেন। প্রত্যেককে শিক্ষিত করেছেন। এমনকি, হিন্দু মতে দুই মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন মুসলমান বাবা-মা।

শ্রীধরন বলেন, ‘ওদের নিজেদের তিন সন্তান। তার সঙ্গে আমরা তিন জন। উম্মা-উপ্পার সংসারে চাপ পড়েছিল। তবে কাউকে তা কখনও বুঝতে দেননি। ওরা ধর্মে মুসলমান। ভীষণ ধর্মপ্রাণ দু’জন। তবে আমাদের তিন ভাইবোনকে কোনোদিন ওদের ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কথা বলেননি। বরং একই পরিবারে আমরা হিন্দু এবং মুসলমান ভাইবোন বড় হয়েছি।’

নিজেদের ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে শ্রীধরন বলেন, ‘আমি এবং আমার দিদিরা মন্দিরে যেতাম কপালে চন্দন টিকা নিয়ে। আমরা মা-বাবা বরাবর তাতে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। তারা আমাদের শিখিয়েছেন, ধর্ম মানে অন্যকে আঘাত করা নয়। চুরি করা পাপ, অসৎ আচরণ করা উচিত নয়, সবাইকে ভালবাসতে এবং সাহায্য করতেও শিখিয়েছেন তারা। আমরা ভাইবোনেরাও কখনও এমন কোনও কাজ করিনি যাতে তারা দুঃখ পান।’

উম্মা সম্পর্কে কথা বলতে গেলে থামতে চান না শ্রীধরন। বলেন, ‘শুনেছি সৎমা নাকি কখনও নিজের হয় না। কিন্তু আমি শুধু শুনেছি। কখনও বুঝিনি যে আমার জন্মদাত্রী অন্য কেউ।’

শ্রীধরন এখনও শিহরিত হন এটা ভেবে যে যদি তাদের জীবনে সুবাইদা নামে মহিলা না আসতেন তা হলে কী হত! একে গরিব, তার উপর ‘নিচু জাত’। সবাই দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করত। তবে ওই নারীর ছত্রছায়ায় এসে শ্রীধরন শিখেছেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে। শিখিয়েছেন, কখনও নিজের অস্তিত্বকে খাটো করে না দেখতে।

শ্রীধরন জানান, তার নিজের বাবার মৃত্যুর পর সৎ বোনকেও মানুষ করার ভার নেন উম্মা-উপ্পা। এমনটা অনেকে ভাবতেও পারেন না। শ্রীধরনের কাহিনি অবাক করেছে নেটিজেনদের। 

৫৫তম আন্তর্জাতিক গোয়া চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে শ্রীধরনদের গল্প। পরিচালক জানান, ফেসবুকের পোস্ট দেখেই তিনি সিদ্ধান নেন এ নিয়ে ছবি করবেনই। হিন্দু এবং মুসলমান পরিবারের ভালবাসার কাহিনিকে যত্নে গেঁথেছেন চিত্রপরিচালক সিদ্দিক পরাভুর। ইতিমধ্যে দর্শকদের পছন্দের তালিকায় ঢুকে পড়েছে ছবিটি।

সূত্র: আনন্দবাজার

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর