শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে
সম্প্রতি বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করতে বাংলাদেশকে তাদের পক্ষে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে

বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার নিয়ে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্যা ডিপ্লোম্যাট। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এবং এ অঞ্চলে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে। একইসাথে বৃহৎ বৈশ্বিক শক্তিগুলোর শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে কার্যকর কূটনীতিক নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশের দুর্বলতার বিষয়গুলোও উঠে এসেছে।  

গণমাধ্যমটির প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


দেশটিতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মার্কিন এবং চীনা কর্মকর্তারা সফর করেছেন। ১৪ জানুয়ারি তারিখে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলাদেশে এসে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এর আগের সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার চার দিনের সফরে বাংলাদেশে ছিলেন। গত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আবদুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি।

মোমেনের সঙ্গে লাউবাচারের বৈঠকের এক দিন পর, বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় পৌঁছান চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটাই তার প্রথম বিদেশ সফর। এ সফরের মাধ্যমে তিনি চীনের কূটনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙেছেন। কারণ এ সময়ে তার আফ্রিকার কোনো দেশে যাওয়ার কথা। তবুও তিনি কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ কারণে প্রথমে ঢাকায় আসেন। মাঝরাতের সময় বিমানবন্দরে এসে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আবদুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করেন। কিনের এ সফর ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ। এটা বাংলাদেশি ও বিদেশি কূটনৈতিক মহলের নজরেও পড়েছে।

কিনের সফরের পরপরই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপ-প্রধান চেন ঝো-এর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। তারা সিসিপির ২০তম জাতীয় কংগ্রেসের চেতনা ব্যাখ্যা করে বক্তৃতাও দেন।

দ্যা ডিপ্লোম্যাট জানিয়েছে, ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি "সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বিদ্বেষ নয়" এমন নীতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করছে। এই কৌশল দেশটির জন্য ভালো ফল বয়ে এনেছে। তবে সম্প্রতি বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করতে বাংলাদেশকে তাদের পক্ষে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


যেমন ২০২০ সালের অক্টোবরে তৎকালীন মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান বাংলাদেশকে কোয়াডে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ সময় তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করেন।

এ সময় তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলে আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হবে বাংলাদেশ।’

এরপরই চীন তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। ২০২১ সালের মে মাসে দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যদি মার্কিন নেতৃত্বধীন জোট কোয়াডে যোগ দেয়, তবে চীনের সঙ্গে দেশটির  সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর এমন প্রতিযোগিতার মধ্যে চীন প্রায়ই বাংলাদেশকে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তবে তারা তাদের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই)-এর কার্যক্রমে যোগ দিতে বাংলাদেশকে প্ররোচিতও করছে।

এদিকে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বাকযুদ্ধ চলছে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোতে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোকে প্রভাবিত করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করছেন।’

এর আগে ঢাকায় অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাস একটি বিবৃতি প্রকাশ করে পশ্চিমা দেশগুলোর আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার সমালোচনা করে বলেছে, ‘তারা নিজেদেরকে উন্নত গণতন্ত্রের ধারক বলে পরিচয় দেয়। অথচ, তারা এ ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ রক্ষার অজুহাতে তাদের স্বার্থবিরোধী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তারা মূলত নিজেদেরকে 'বিশ্বের শাসক' বলে মনে করে।’

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে পিটার ডি হাসের ক্রমবর্ধমান তৎপরতার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছে রাশিয়া। এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও মানবাধিকার নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এছাড়া বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে তিনি শঙ্কাও প্রকাশ করেন।

তবে রুশ-মার্কিন কূটনীতিক তৎপরতা নিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আবদুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ চায় না রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুক।’

দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত জায়গায় বাংলাদেশের অবস্থান দেশটিকে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়েছে। ভূ-রাজনীতির অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ রবার্ট কাপলান ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘ভারত মহাসাগর হবে বিশ্বব্যাপী সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু’। কারণ বিশ্ব অর্থনীতিতে শিপিং বা পরিবহনের রুট হিসেবে এর গুরুত্ব রয়েছে।

ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরে পরাশক্তিগুলোর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।

অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ সারা বিশ্বেই সুবিদিত। ভারত মহাসাগর এবং এর বিভিন্ন উপসাগর দিয়ে আফ্রিকার সাথে চীনের বেশিরভাগ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এছাড়া নিজেদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এই অঞ্চলে চীনা উপস্থিতি বাড়ানোরও চেষ্টা করেছে বেইজিং। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে।

দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, অতীতে পাকিস্তান এবং ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বলে যদি এখন ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বলতে হবে ওয়াশিংটন এখন ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশ, নেপাল ও মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

এছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ সোচ্চার হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশের এলিট আধাসামরিক বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর সাতজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন।

অবশ্য বড় পরাশক্তি দেশগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ আরও দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সংকট, সরকারের বৈধতা নিয়ে সংকট, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে দেশটির স্বাধীন ও যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।

দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল; বাংলাদেশি পণ্যের একক বৃহত্তম বাজারও যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া এশিয়ায় যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি মার্কিন সাহায্য পেয়ে থাকে বাংলাদেশ সেসব দেশের একটি।

অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক। বাংলাদেশে বেইজিংয়ের বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা কোনো একক দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি।

পরাশক্তি দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সীমিত করেছে বলে দাবি ডিপ্লোম্যাটের।

এমন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ইস্যুকে ব্যবহার বাংলাদেশকে তার নিজের আয়ত্তে আনতে চাইছে। অপরদিকে চীন এবং রাশিয়া বর্তমান সরকারকে আর্থিক সহায়তাসহ নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে আসছে এবং এটিকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে।

যখন বৃহৎ শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করছে, তখন বাংলাদেশের বর্তমান সরকার রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার দিকে মনোনিবেশ করেছে। একইসাথে দেশটিতে সাধারণ মানুষের চাহিদাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

সূত্র : দ্যা ডিপ্লোম্যাট

এমইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর