শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

যেসব কারণে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে লাখো ইসরায়েলি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:২৬ এএম

শেয়ার করুন:

যেসব কারণে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে লাখো ইসরায়েলি

ইসরায়েলের বিচার বিভাগ-সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়ায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছে লাখ লাখ ইসরায়েলি। শনিবার দেশটির রাজধানী তেল আভিভ, জেরুসালেম ও হাইফা শহরে নজিরবিহীন এই বিক্ষোভ দেখা যায়। 

এদিকে আইন পরিবর্তনের ঘোষণায় ইসরায়েল এবং অধিকৃত এলাকাগুলোতে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও তীব্র উদ্বেগ ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। বিক্ষোভকারীদের মতে— নেতানিয়াহুর ঘোষণা অনুযায়ী আইন পরিবর্তন করলে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে তারা নেতানিয়াহুকে ইসরায়েলের গণতন্ত্রের জন্য এক ‘মূর্তিমান বিপদ’ হিসেবে দেখছেন। 


বিজ্ঞাপন


কেন এই বিক্ষোভ
২০২১ পর্যন্ত বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু টানা ১২ বছর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে তার নেতৃত্বে গঠিত এবারের সরকারকে বলা হচ্ছে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্র ডানপন্থী। নেতানিয়াহুর কোয়ালিশনে অংশীদার দলগুলোর মধ্যে আছে অতি উগ্র ডানপন্থী, কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং অত্যন্ত গোঁড়া ইহুদি রাজনৈতিক দলগুলো।

নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা দেয়, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণ করাই হচ্ছে তাদের প্রথম অগ্রাধিকার। যদিও ইসরায়েল রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পর লাখ লাখ ফিলিস্তিনি পরিবার ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইনে এখানে ইহুদি বসতি নির্মাণ অবৈধ হলেও এখন পর্যন্ত ইসরায়েল ৫ লাখ ইহুদির জন্য বসতি নির্মাণ করেছে। 

কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু কোয়ালিশন গঠনের জন্য কট্টরপন্থী একটি দলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে অধিকৃত পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের অংশে পরিণত করবেন তিনি। যদিও অধিকৃত এই অংশে প্রায় আড়াই লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করছেন। 

নেতানিয়াহু


বিজ্ঞাপন


কী আছে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনায়?
নেতানিয়াহু সরকারের আনা পরিকল্পনায় ইসরায়েলের বর্তমান বিচার বিভাগে ব্যাপক পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। এতে ইসরায়েলের হাইকোর্টের ক্ষমতা কমানো হবে এবং পার্লামেন্টের সদস্যরা এমন সব আইন পাস করতে পারবেন- যা আদালত এর আগে খারিজ করে দিয়েছে বা কার্যত অসাংবিধানিক বলে মত দিয়েছে।  

বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিন বলেন, নতুন পরিকল্পনায় ইসরায়েলের ১২০ আসনের পার্লামেন্ট বা কনেসেটের ক্ষমতা এমনভাবে বাড়বে যে তারা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ ৬১ জন এমপির সমর্থন পেলেই – সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারবেন।

পরিকল্পনায় আরও বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ করা হবে। মন্ত্রীরা তাদের নিজস্ব আইনী উপদেষ্টা নিয়োগ করতে পারবেন।

নেতানিয়াহুর মিত্র উগ্র-জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় গোঁড়াপন্থীরা বলছেন, তারা আশা করছেন অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমিতে ইসরায়েলি বসতি বা ‘আউটপোস্ট’ নির্মাণকে অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট যেসব রুলিং দিয়েছে - সেগুলো তারা খারিজ করতে পারবেন।

ইয়ারিভ লেভিন বিচারপতিদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এমন কিছু লোক এখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যাদের জনগণ ভোট দেয়নি। তার মতে— প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোর কারণে ইসসরায়েলি বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। এতে এই বিভাগের ওপর জনগণের আস্থাও ফিরে আসবে। 

নেতানিয়াহুর যখন বিচার চলছে, তখনই পরিবর্তনের উদ্যোগ
যখন বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেই ঘুষ, জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় বিচারাধীন ঠিক তখনই বিচার বিভাগে এসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে। যদিও এসব অভিযোগ জোর গলায় অস্বীকার করেছেন দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী। 

রাফি বার্গ বিবিসির বিশ্লেষক। তিনি বলছেন, এই নতুন সরকার বিচার বিভাগে পরিবর্তন আনার পর নেতানিয়াহুর বিচার বাতিলের জন্য একে ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও নতুন সরকার এখনও বলেনি যে তারা এমন কিছু করবে।

তাছাড়া যেদিন এই পরিকল্পনা ঘোষণা করা হলো, তার এক দিন পরেই সুপ্রিম কোর্টে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার একটি নিয়োগের বিরুদ্ধে একটি আইনী চ্যালেঞ্জের শুনানি হয়। ওই ভাবী মন্ত্রী হচ্ছেন অতি-গোঁড়া শাস পার্টির নেতা আরিয়েহ ডেরি- তার ওপর ট্যাক্স ফাঁকির জন্য একটি মামলায় স্থগিত দণ্ডাদেশ রয়েছে। 

ইসরায়েল

আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতে দোষী সাব্যস্ত এবং দণ্ডিত এই ব্যক্তিকে মন্ত্রী নিয়োগের জন্য ইসরায়েলি পার্লামেন্ট একটি আইন সংশোধন করেছিল।

বিবিসির বিশ্লেষক বলছেন, এর বিরুদ্ধে করা আপিল যদি গ্রাহ্য হয়- তাহলে তা আদালত ও সরকারের মধ্যে একটি ‘শোডাউনে’ পরিণত হতে পারে।

অন্যদিকে এই পরিকল্পনা যদি আইনে পরিণত হয় তাহলে, সরকারের জন্য অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণের পক্ষে আইন করা সহজ হয়ে যেতে পারে। কারণ তাহলে সরকারকে আর সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে আইনী চ্যালেঞ্জ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না।

মনে রাখতে হবে অধিকৃত পশ্চিম তীরে অতীতে বহু মামলা ধরে চলার কারণে ইহুদি বসতি নির্মাণ বা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা বছরের পর বছর আটকে ছিল।

অনেকদিন ধরেই ‘পরিবর্তনের’ কথা বলছিল লিকুদ পার্টি
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভকে পাত্তা দিতে চাচ্ছেন না তিনি। তার মতে— তার বিরোধী বামপন্থীরা গত নভেম্বর মাসের নির্বাচনের ফলাফল মানতে চাইছে না। তিনি এও বলেন, বিচার বিভাগে তার পরিবর্তন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। 

প্রকৃতপক্ষে লিকুদ রাজনীতিবিদরা অনেকদিন ধরেই ইসরায়েলের উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে আসছে। তারা বলছে, সুপ্রিম কোর্টে বামপন্থী বিচারপতিদের প্রাধান্য আছে। তারা রাজনৈতিক কারণে ‘বিচারবিভাগীয় ক্ষমতার সীমার বাইরের বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন।’

তারা ইসরায়েলি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, প্রস্তাবিত পরিবর্তন পাস হলে ইসরায়েলি গণতান্ত্রিক ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ বা ক্ষমতার ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়বে। 

তারা বলছেন, বিচারবিভাগীয় নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালো হবে, ইসরায়েলি পার্লামেন্ট বা কনেসেটে পাস করা আইনকে খারিজ করে দেওয়ার যে ক্ষমতা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আছে - তা সীমিত করবে।

বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের আশঙ্কা- ক্ষমতাসীনদের প্রস্তাবিত পরিবর্তন পাস হলে বিচারকদের স্বাধীনতা খর্ব হবে, সরকার ও পার্লামেন্টের কাজের ওপর নজরদারি দুর্বল করে ফেলবে, সংখ্যালঘু ও সমকামীদের অধিকার খর্ব হবে, এবং আরও বেশি দুর্নীতির বিস্তার ঘটবে।

বিক্ষোভ

এদিকে এসব কারণে নাগরিকদের এই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন নেতানিয়াহু-বিরোধী রাজনীতিবিদরাও। 

বিরোধী দলের নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদ বলছেন, এই প্রতিবাদ হচ্ছে দেশকে রক্ষার জন্য। আমি এই বিক্ষোভে এসেছি গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য।

ইসরায়েলি বার সমিতির প্রধান আভি চিমি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, নেতানিয়াহু ও তার জোট ইসরায়েলকে একটি একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, তারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়।

‘তারা চাইছে বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে ধ্বংস করতে, কিন্তু বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক দেশ সম্ভব নয়।’

উচ্চতম আদালতের ক্ষমতার সমর্থকরা বলছেন, ইসরায়েলের মতো একটি দেশে যেখানে আনুষ্ঠানিক কোনো সংবিধান নেই সেখানে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য আদালতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জনসমর্থন কোন দিকে?
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট নামে এক প্রতিষ্ঠান একটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। 

এতে দেখা যায়, বামপন্থী ইসরায়েলিদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ওপর আস্থা ডানপন্থীদের তুলনায় বেশি। কিন্তু সার্বিকভাবে আদালতের ক্ষমতা কমানোর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমর্থন নেই।

এদিকে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেছেন ইসরায়েলের আইনজীবী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতারাও। 

বেশ কিছুকাল থেকে বিশ্লেষকরা বলছিলেন, ডানপন্থীদের প্রভাব বাড়ছে ইসরায়েলের সমাজে। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো থেকেও এটা স্পষ্ট হচ্ছিল যে ইসরায়েলি সমাজে রাজনৈতিক বিভক্তি বাড়ছে।

বিচার বিভাগ-সংক্রান্ত আইন সংস্কারের জন্য যে পরিকল্পনা তুলে ধরেছে ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী-প্রধান সরকার তাতে এ বিভক্তি আরো প্রকট হবে এটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

সূত্র: বিবিসি

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর