শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

ফিলিস্তিনি কবির ইহুদি প্রিয়তমা

তাসীন মল্লিক
প্রকাশিত: ১৩ মার্চ ২০২২, ০৪:৪২ পিএম

শেয়ার করুন:

ফিলিস্তিনি কবির ইহুদি প্রিয়তমা

১৯৪১ সালের আজকের দিনে (১৩ মার্চ) জন্মগ্রহণ করেন সেলিম এবং হুরেইয়া দারবিশের দ্বিতীয় সন্তান মাহমুদ দারবিশ। শুভ জন্মদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্বের কবি।

ইসরায়েলি-আরব চলচ্চিত্র নির্মাতা ইবতিসাম মারানা মেনুহিন। ২০০৫ সালে উত্তর আরবের শহর ফুরিদিস থেকে তেল আবিবে খুঁজে নেন নিজের নতুন বাসস্থান। সহসাই ইসরাইলের রাজধানীতে প্রতিবেশী কানাডীয় ইহুদি বোয়াজ মেনুহিনের প্রেমে পড়েন মারানা। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মারানা। আরব-ইসরাইলের যৌথ প্রকল্প ‘গিভাত হাভিভা’র ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী মারানা পরিচিত হন ‘পরিচয়পত্র’ নামক কবিতার সাথে। কবিতার প্রতিটি পরতে পরতে যেন নিজের প্রণয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান মারানা। পরিচয়পত্রের প্রথম লাইন ধার করে মারানার নির্মিত ‘আমি একজন আরব’ শীর্ষক জীবনীমূলক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়ে টরন্টোর হট ডক্স ফেস্টিভ্যালে। কবিতার রচয়িতা এক ফিলিস্তিনি প্রেমিককে খুঁজে পায় বিশ্ব, নাম মাহমুদ দারবিশ।


বিজ্ঞাপন


১৯৪৮ এর আরব ইসরাইল যুদ্ধে নিজের জন্মভূমি হারান দারবিশ। ইহুদি দখলদারিত্ব থেকে বাঁচতে প্রথমে লেবাননের জেনিন এবং পরে দামুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন দারবিশ। কয়েক বছর পরেই জন্মভূমির মায়ায় তার পরিবার ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে।

darwish funeral
দারবিশের শেষকৃত্যে অংশ নেয়া মানুষের ঢল

দারবিশ পিতামহের কাছে লাভ করেন অক্ষর জ্ঞান। মাতৃভূমি হারানোর বেদনা প্রতিফলিত হতে শুরু করে তার অক্ষরে অক্ষরে। নির্বাসনের যন্ত্রণাকে ‘লস অব ইডেন’ রূপকে প্রকাশ করতে শুরু করেন দারবিশ। ১৯ বছর বয়সেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম ‘আসাফির বিলা আজনিহা’ বা ‘ডানা ভাঙা পাখি’।

‘রিটা’ এক অমর প্রেমাখ্যান


বিজ্ঞাপন


উদ্বাস্তু দারবিশ তার জীবনব্যাপী ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন। কখনও রামাল্লা আবার পশ্চিম তীর, ইসরাইলি দখলদারদের চোখ রাঙানি তাকে কোথাও থিতু হতে দেয়নি। ১৯৯৫ সালে সহকর্মী এমিল হাবিবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদানের জন্য হাইফাতে পৌঁছান তিনি। হাইফাতেই ইহুদি নারী তামার বেন-অমির প্রেমে পড়েন দারবিশ।

হাইফাতে কমিউনিস্ট পার্টির এক সমাবেশে দেখা হয় দু’জনার। প্রবল ভালোবাসা জন্ম দেয় বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া কবিতা ‘রিটা অ্যান্ড দ্য রাইফেল’ ।

মোট তিনটি কবিতায় দারবিশ চিত্রিত করেছেন তার ইহুদি প্রেমিকা তামারাকে। কবিতায় তামারার রূপক নাম ‘রিটা’। প্রতিটি কবিতায় একজন ইসরায়েলি মহিলা এবং একজন ফিলিস্তিনি পুরুষের মধ্যে প্রেমের অন্তর্নিহিত ব্যক্তিগত, মানবিক ট্র্যাজেডির একটি ভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন দারবিশ।

tamara and darwish
দারবিশ এবং তার ইহুদি প্রেমিকা তামারা

রিটার সঙ্গে প্রেমের দ্বন্দ্ব, জাতীয় যন্ত্রণা এবং আচরণের অসংলগ্নতা ছুঁয়েছে পাঠকের হৃদয়। আপাদমস্তক রাজনৈতিক কবি মাহমুদ দারবিশ রিটা চরিত্রটিকে এমনভাবে চিত্রিত করেছেন যেন পাঠক বিভ্রান্ত হয়েছেন। বার বার প্রশ্ন করেছেন ‘রিটা কি শুধুই একজন ব্যক্তি নাকি আরও বড় কিছুর প্রতীক’।

ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর

ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে, ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে এবং লাখ লাখ আরবকে সমবেত করতে বহু মহাকাব্য রচনা করেছেন কবি মাহমুদ দারবিশ।

দারবিশের কবিতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রশংসনীয় বিষয় ছিল দৃঢ় মানবতাবাদ এবং সর্বজনীনতাবাদিতা। সাহিত্যে তার অনুপ্রেরণা ছিল ফরাসি কবি জ্যা আর্তুর র‌্যাবো। হয়ত র‌্যাবোই তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন সস্তা জাতীয়তাবাদ ও অরাজকতাবাদের কাছে নতি স্বীকার না করার।

দারবিশ নিজেও ছিলেন একজন সার্বজনীন চরিত্র। হিব্রু ভাষার ইহুদি কবিরা মুগ্ধ হয়েছিলেন তার সাহিত্যে। আরবি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ এবং হিব্রুতেও পারদর্শী ছিলেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব মস্কোর সাবেক শিক্ষার্থী কবি দারবিশ।

২০০০ সালে দারবিশে মুগ্ধ ইসরাইলি শিক্ষামন্ত্রী ইয়োসি সারিদ প্রস্তাব করেছিলেন যে দারবিশের দুটি কবিতা ইসরায়েলের উচ্চ বিদ্যালয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতায় তা বাতিল হয়।

zaqtan and darwish
দুই কিংবদন্তী ফিলিস্তিনি কবি ঘাসান জাকতান এবং মাহমুদ দারবিশ

রাজনৈতিক কারণে দারবিশের ওপর ছিল ইসরাইলের বৈরী নজরদারি। ইসরাইলের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকাসহ একাধিক সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) অংশগ্রহণের জন্য ইসরাইলে নিষিদ্ধ করা হয় দারবিশকে।

৯ আগস্ট ২০০৮ সালের মৃত্যুর পর দারবিশকে সমাহিত করা হয় রামল্লায়। শেষ পর্যন্ত নিজ মাতৃভূমিতে থিতু হন ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক। যদিও নিজের শহর পশ্চিম গ্যালিলের আল-বিরওয়াতে ফেরা হয়নি তার। যে দখলীকৃত ভূমিতে হয়ত এখনও চাপা পড়ে আছে দারবিশের শৈশব।

১৯৪১ সালের আজকের দিনে (১৩ মার্চ) জন্ম গ্রহণ করেন সেলিম এবং হুরেইয়া দারবিশের দ্বিতীয় সন্তান মাহমুদ দারবিশ। শুভ জন্মদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্বের কবি।

টিএম/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর