ব্লেইস ক্যাম্পাওরে, দীর্ঘ ২৭ বছর শাসন করেছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুর্কিনা ফাসো। জৈব-ভৌগলিক অঞ্চল সাহেলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতি শুরু হয় ২০১৪ সালে। বুরকিনাবেদের গণজোয়ারে পতন হয় ক্যাম্পাওরের। বিশ্লেষকরা যে ঘটনাকে অভিহিত করেছিল ‘আরব বসন্ত’-এর পশ্চিম আফ্রিকার সংস্করণ হিসেবে। বুর্কিনা ফাসোর জনস্রোত প্রাথমিক বিজয় অর্জন করলেও জন্ম নিয়েছে জাতীয় সংকট। ২০১৫ সালের পর থেকে দেশটির রাজনৈতিক সংকট থামছে না। বুরকিনাবেদের জোয়ার অস্থিতিশীল করে তুলেছে সমগ্র সাহেল অঞ্চল সাহেলকে।
উত্তরে সাহারা মরু আর দক্ষিণে সুদানিয়ান সাভানা, মাঝে বর্ষাঞ্চল সাহেল। আফ্রিকার কৃষি ভূমি, অঞ্চলটির ৯০ শতাংশ মানুষের পেশা কৃষি নির্ভর। অঞ্চলটির অস্থিতিশীলতায় দায়ী একাধিক গোষ্ঠীর সংঘাত। তুয়ারেগদের মত নৃ-গোষ্ঠী কিংবা দ্রুত বর্ধনশীল সহিংস গোষ্ঠী জামাত নুসরাত আল-ইসলাম ওয়াল-মুসলিমের মত মতাদর্শিকরা, উভয়েই উত্তাপ ছড়াচ্ছে অঞ্চলটিতে।
যাযাবর তুয়ারেগ
আফ্রোএশিয়াটিক পরিবারের প্রাচীন নৃগোষ্ঠী তুয়ারেগ। খ্রিষ্টের জন্মের ৫০০ বছর পূর্বেই এ যাযাবর জাতির উদ্ভব। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের ৬ দেশ জুড়ে অবস্থান করে নীল পোশাকের জাতিটি। ট্রান্স-সাহারান বাণিজ্য রুটের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাদের হাতে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে সাহারান অঞ্চলে বিভিন্ন সংঘাতের অংশ তারা।
২০১৯ সাল থেকে তুয়ারেগদের সাথে একাধিক গোষ্ঠীর সংঘাত নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। সশস্ত্র সংঘাতের অবস্থান ও ইভেন্ট ডেটা প্রকল্প (ACLED) অনুসারে, ২০১৯ সালে সংঘাতে সহিংসতার সংখ্যা বিগত আট বছরের মোট সহিংসতার দ্বিগুণ। ২০২১ সালে সহিংসতার ফলে কমপক্ষে ২৩৫৪ জন নিহত হয়েছে। বুর্কিনা ফাসোর সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে মালিসহ সাহেল অঞ্চলের একাধিক দেশে। প্রান্তিক তুয়ারেগদের দ্বারা প্রতিবেশী মালিতে বিদ্রোহ হিসাবে যা শুরু হয়েছিল তা এখন পুরো সাহেল অঞ্চলকে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে।
খনিজ সংঘাত
বুর্কিনা ফাসোও সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ খনিজ সম্পদ। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি সোনার খনি এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বাণিজ্য রুটগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এছাড়া বুরকিনা ফাসো স্থলবেষ্টিত সাহেল দেশগুলিকে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলের সাথে সংযুক্ত করে। উপকূলীয় রাজ্যগুলির আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রও এটি। ফলে বুর্কিনা ফাসো কেন্দ্রিক ক্ষমতা দখলই অঞ্চলটিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য।
বুর্কিন ফাসোর প্রতিবেশী মালিতে একাধিকে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে বিগত তিন বছরে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট বাহ এন’দাও ও প্রধানমন্ত্রী মোক্তার ওয়ানকে আটক করা হয়। বুর্কিনাবে ভিত্তিক ইসলামিস্ট ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন দেশটিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনা করে আসছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র নাইজেরেও রয়েছে তাদের কার্যক্রম। খনির ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একে অপরের ওপর বর্বর আগ্রাসন চালাচ্ছে।
সংঘাতের ফল ভোগ করছে সাহেলের সাধারণরা। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই কোটি জনসংখ্যার দেশ বুরকিনা ফাসোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। আনুমানিক ১.৭ মিলিয়ন মানুষ নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এমনকি অসাংবিধানিকভাবে সরকার পরিবর্তনের অভিযোগে চার রাষ্ট্রকে শান্তি ও নিরাপত্তা পরিষদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ)। যে তালিকায় রয়েছে বুর্কিনা ফাসো। একই অভিযোগে ২০২০ সালেই এইউ থেকে বহিষ্কার হয়েছিল মালি।
ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত সাহেল অঞ্চলটির সাধারণরা সংঘাতকে আত্তীকরণ করে চলছে শতাব্দী যাবত। বহু বছরের শাসন-শোষণের পর ফরাসি ঔপনিবেশ মুক্ত হয় সাহেল। অঞ্চলটির অস্থিতিশীলতায় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে।
সূত্র: পলিটিকো, আলজাজিরা