শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

এনডিটিভির মালিকানা বদল: সেই কণ্ঠস্বর থাকবে কি?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

এনডিটিভির মালিকানা বদল: সেই কণ্ঠস্বর থাকবে কি?
এনডিটিভি কিনে নিয়েছেন শিল্পপতি গৌতম আদানি

ভারতীয় খবরের চ্যানেল - তা সেটা ইংরেজি হোক বা হিন্দি - দেখলেই বোঝা যায় যে মোটামুটিভাবে একপক্ষীয় খবরেরই প্রাধান্য সেখানে। আর সেই পক্ষটা হলো বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষের খবর।

যখন কোনো টিভি বিতর্ক চলে, তা ভারত শাসিত কাশ্মির হোক বা পাকিস্তান অথবা চীন হোক কিংবা এমন কোনো খবর যেখানে মুসলমানরা জড়িত, প্রায় সব চ্যানেলেই একই ধরনের কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যায়। চ্যানেলের লোগোটা না থাকলে অথবা উপস্থাপকদের চেনা না থাকলে বোঝা দায় হয়ে যায় যে কোন চ্যানেলের বিতর্ক আপনি দেখছেন।


বিজ্ঞাপন


এই অবস্থায় কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যেত এনডিটিভিতে।

সরকারবিরোধী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল এনডিটিভি

এনডিটিভিতে সরকার পক্ষ বা সরকারি দলের প্রতিনিধিদের উপস্থাপকদের কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হত। শক্ত প্রশ্ন তোলা হতো সরকারি নীতি নিয়ে।

প্রশ্ন উঠেছে এনডিটিভি যেভাবে বিরোধী কণ্ঠস্বর বা 'ভয়েস অফ ডিসেন্ট' তুলে ধরত তা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে কিনা, তা নিয়ে।


বিজ্ঞাপন


প্রশ্নগুলো উঠছে এই কারণে যে এনডিটিভির মালিকানা বদল এখন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।

চ্যানেলটির প্রোমোটার সংস্থা আরআরপিআর হোল্ডিংসের সিংহভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ব্যক্তি শিল্পপতি গৌতম আদানীর অধীনস্থ একটি সংস্থা।

এনডিটিভির প্রতিষ্ঠাতা প্রণয় রায় চেষ্টা করেছিলেন এই শেয়ার হস্তান্তর রুখতে, কিন্তু পারেননি। শেয়ার মার্কেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা নির্দেশ দেয় যে এই হস্তান্তর একেবারেই আইন মেনে করা হয়েছে - কোনো অনিয়ম নেই।

তারপরেই এনডিটিভির হোল্ডিং কোম্পানি থেকে দু’দিন আগে পদত্যাগ করেছেন প্রণয় রায় আর তার স্ত্রী রাধিকা রায়। আর বুধবার এনডিটিভির হিন্দি চ্যানেলের সম্পাদক রভিশ কুমারও পদত্যাগ করেছেন।

অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন করছেন এনডিটিভি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরে কি তাহলে ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোতে আর স্বাধীন কণ্ঠস্বর শোনা যাবে না? তারা যেভাবে সরকারবিরোধিতার কণ্ঠস্বর তুলে ধরত, তা কি চাপা পড়ে যাবে?

ভারতের প্রথম বেসরকারি টিভি অনুষ্ঠান

"এভাবে যে এনডিটিভি বিক্রি হয়ে যাবে সেটা তো প্রত্যাশা করিনি। কী এক ভয়ঙ্কর শক্তি, যে অন্য কাউকে টিঁকে থাকতে দেবে না!" বলছিলেন কলকাতার একটি কলেজের অধ্যাপিকা ও সমাজকর্মী আফরোজা খাতুন।

এনডিটিভি আশির দশকের শেষ দিকে কাজ শুরু করে সরকারি টিভি চ্যানেল দূরদর্শনে একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

'

এনডিটিভির প্রতিষ্ঠাতা প্রণয় রায়

দা ওয়ার্ল্ড দিস উইক' নামের ওই অনুষ্ঠানটিতে আন্তর্জাতিক খবর আর সংবাদ বিশ্লেষণ দেখানো হতো।

তাদের খবর, উপস্থাপনা সবই ছিল সরকারি দূরদর্শনের একেবারে বিপরীত - আন্তর্জাতিক মানের।

দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওই অনুষ্ঠানটি।

এরপরে প্রণয় রায় নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণের অনুষ্ঠান করতেন ওই দূরদর্শনেই।

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এনডিটিভির ইংরেজি ও হিন্দি চ্যানেল দুটির জন্ম হয়।

এনডিটিভি হিন্দি চ্যানেলের রভিশ কুমারের পদত্যাগ

"ড. প্রণয় রায় নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় টিভি সাংবাদিকতার একটা প্রতিষ্ঠান," বলছিলেন সাবেক সংবাদকর্মী ও এখন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র কেয়া ঘোষ।

নিজের তৈরি ওই প্রতিষ্ঠান থেকেই পদত্যাগ করলেন প্রণয় রায় ও তার স্ত্রী রাধিকার রায়। তবে তাদের দু’জনের এনডিটিভি ছেড়ে চলে যাওয়ায় যত না প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে এনডিটিভির হিন্দি চ্যানেলটির সম্পাদক রভিশ কুমার বুধবার পদত্যাগ করায়।

এনডিটিভির হিন্দি চ্যানেলের সম্পাদক রভিশ কুমার

এ বিষয়ে বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক শিখা মুখার্জী বলেন, ‘রভিশ কুমারের পদত্যাগের পরে যে ধরণের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি, তার একটা কারণ হলো তিনি হিন্দিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতেন। তিনি দর্শকদের কাছে শুধুই এনডিটিভির একজন সম্পাদক বা উপস্থাপক ছিলেন না। হিন্দি বলয়ে তার বিরাট একটা ভক্তকুল আছে, যারা রভিশ কুমারের অবস্থান, বিভিন্ন ইস্যুতে তার বক্তব্যগুলোকে সমর্থন করেন। তার অনুষ্ঠানে স্বাধীনভাবে বক্তব্য রাখার একটা জায়গা ছিলো, যেটা এখন আর রইল না।’

'তাদের সাংবাদিকতা একপেশে, শুধুই বিজেপি বিরোধিতা'

এনডিটিভি ও রভিশ কুমারের সাংবাদিকতা স্বাভাবিক কারণেই বিজেপি এবং অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ভালো চোখে দেখে না। তারা মনে করে এনডিটিভির সাংবাদিকতা অনেকটাই বিজেপিবিরোধী অ্যাক্টিভিজম এবং কিছু খবর তো ভুয়া।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র কেয়া ঘোষ বলেন, "যে প্রজন্মটা এনডিটিভির সেই দ্যা ওয়ার্ল্ড দিস উইক দেখে বড় হয়েছে, আমিও তাদেরই একজন। আগেই বলেছি, ড. প্রণয় রায় নিজেই সাংবাদিকতার একটা ইনস্টিটিউশন। কিন্তু পরবর্তীকালে এনডিটিভি একপেশে এবং কিছু ক্ষেত্রে তো ভুয়ো খবরও করা শুরু করে। তারা যেন পণ করে নিয়েছিল যে তাদের কাজ হবে কংগ্রেসের পক্ষে, বিজেপির বিপক্ষে সংবাদ উপস্থাপন করা।"

তিনি বলেন, "নরেন্দ্র মোদি ভাল কিছু করলেও সেটাতে ভুল ধরা, আর খারাপ কিছু করলে তো ভুল ধরবেই। যেনতেন প্রকারে বিজেপি বিরোধিতা করাটাই তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। সংবাদকর্মীদের কি সেটা করা সাজে? এটাকে অ্যাক্টিভিজম না বললে আর কি বলব?"

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিশ্বের তৃতীয় সবথেকে ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানী (একেবারে বাঁয়ে)

'এনডিটিভি স্বাধীনই থাকবে': আদানি

এনডিটিভি কেনার পথ আরও সুগম হওয়ার পরে শিল্পপতি গৌতম আদানি ফিনান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অবশ্য বলেছেন যে তিনি এনডিটিভিকে স্বাধীন চ্যানেল হিসেবেই দেখতে চান।

তার কথায়, "একটা সংবাদ মাধ্যমকে স্বাধীন অবস্থান নিতে দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে কেন প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না?  ভারতে তো ফিনান্সিয়াল টাইমস বা আল-জাজিরার মতো সংবাদ সংস্থা নেই।"

তিনি আরও আশ্বস্ত করেছেন যে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা মানে সরকার যদি কোনো ভুল করে, তাহলে সেটাকে ভুলই বলা উচিত, তবে সরকার যদি কোনো সঠিক কাজ করে, সেটাকেও স্বীকৃতি দেওয়ার সাহসটাও দেখাতে হবে।

সূত্র : বিবিসি

এমইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর