বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে ইরান। হিজাব না পরায় গ্রেফতার ও পরে পুলিশের হেফাজতে ২২ বছরের কুর্দি তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু ঘিরে এই বিক্ষোভের সূত্রপাত। নরওয়ের একটি অধিকার গ্রুপ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৭৬ জনের।
তবে ইরানি কর্তৃপক্ষ এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক বলে জানিয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার জনকে।
বিজ্ঞাপন
এদিকে হিজাববিরোধীদের বিক্ষোভকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা বিক্ষোভ করেছে হিজাব আইনের পক্ষের হাজার হাজার লোক। তাদেরকে ইরানের শক্তি বলে উল্লেখ করেছেন প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় ২২ বছরের মাশা আমিনিকে। ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ হেফাজতেই মৃত্যু হয় তার। ওই তরুণীর পরিবার ও বহু ইরানি নাগরিকের বিশ্বাস যে হেফাজতে মারাত্মক প্রহারের কারণেই মৃত্যু হয়েছে মাশার।
তবে পুলিশ তার সাথে দুর্ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছে এবং বলেছে যে ‘হঠাৎ করে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া’ বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা যদি এখনই এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ান তাহলে একদিন তাদেরও একই ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
ইরানের এই বিক্ষোভ কি শুধুই হিজাব বা পোশাকের স্বাধীনতার বিষয়ে, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো বিষয়?
১৯৭৯ সালে একটি সর্বাত্মক বিপ্লব ইরানকে পাশ্চাত্যপন্থী দেশ থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করেছিল। এ বিপ্লবকে বলা হয় ফরাসি এবং বলশেভিক বিপ্লবের পর ইতিহাসের তৃতীয় মহাবিপ্লব। এরপরই শিয়া অধ্যুষিত দেশটিতে ইসলামি নানা আইন বলবত হয়।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব নারীদের রক্ষণশীল পোশাক পরার বিষয়টিকে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে কঠোর হিজাববিধি নিয়ে সেই সময় থেকেই দেশটিতে একটি বিরোধ আছে। সংস্কারপন্থীরা মনে করছেন এই আন্দোলনের তীব্রতার পেছনে এতদিন তাদের জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছে।
বিবিসির এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ঘটনাটি এমন সময় ঘটেছে যখন ইরানের মানুষ এমনিতেই ক্ষুব্ধ। রাজনীতিকদের দুর্নীতি, ৫০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতির কারণে দারিদ্র বেড়ে যাওয়া, পারমাণবিক আলোচনায় অচলাবস্থা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে হতাশ করে তুলেছে। এটি তারও একটি বহিঃপ্রকাশ।
ইরানে এটি বিক্ষোভের নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষকের মতে আগের যেকোনো ঘটনার তুলনায় এবারের আন্দোলনে ভিন্নতা আছে।
দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেইনির বয়স এখন ৮৩ বছর। তার অসুস্থতার বিষয়টিও বহু ইরানি নাগরিকের চিন্তায় আছে। বিরোধীরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকার ও প্রশাসনের ভিতে আঘাত করতে চাচ্ছেন। এটিকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন সংস্কারপন্থীরা।
এছাড়া নানা কারণে বৈষম্যের শিকার হওয়া কুর্দিরাও তাদের জাতিগত নিপীড়ন রুখতে একত্রিত হয়েছেন। মাশা আমিনির মৃত্যুকে জাতিগত নির্যাতন হিসেবে দেখছে কুর্দিরা।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চলমান বিক্ষোভ বর্তমান শাসকদের চূড়ান্ত অধ্যায় নাও হতে পারে। তবে এটি যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ইরান বিপ্লবের পর থেকে নানা সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের গুপ্ত হামলার শিকার হয়েছে ইরানের শীর্ষ ব্যক্তিরা। নিষেধাজ্ঞার মতো সর্বোচ্চ গুরুতর অস্ত্র এখনো বহাল রয়েছে ইরানের ওপর। এতদসত্ত্বেও নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। সেই পথই পশ্চিমারা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং আন্দোলনে উৎসাহ যোগাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ইবরাহিম রাইসি সরকার।
এখন কথা হলো এই বিক্ষোভের পরিণতি কী হতে পারে? সত্যি বলতে নেতৃত্বহীন এই বিক্ষোভ দমনে এরই মধ্যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। কোনো নেতা বা গ্রুপ না থাকায় আন্দোলন বেগবানের জন্য যেসব রশদ দরকার তার অভাব শিগগিরই বোধ করবেন বিক্ষোভকারীরা। সরকারি কঠোর অবস্থানের কারণে এটি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আর যদি বিক্ষোভকারীরা তাদের অবস্থানে অনড় থাকেন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি বা টিয়ার গ্যাসের সামনে বুক পেতে দিতে পারেন তাহলে ঘটনা উল্টে যেতে পারে। তবে তার জন্য সীমাহীন ধৈর্য আর নির্মম দৃশ্যের মোকাবেলা করতে হবে। যা হয়তো শেষ পর্যন্ত ঘটা প্রায় অসম্ভব। যদি ঘটে যায় তাহলে বিশ্ব দরবারে প্রশ্নের মুখে পড়বে ইরান। কেঁপে যেতে পারে শাসকদের চেয়ারও।
সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, উইকিপিডিয়া।
একে