বহুল প্রাপ্য ইউরেশিয়ান বাদামি ভাল্লুক রাশিয়ার শৈর্য-বীর্যের প্রতীক। ১৬ শতকের প্রথম দিকে রুশদেশ সম্পর্কিত কার্টুন, নিবন্ধ এবং নাটকে ব্যবহৃত হতে থাকে প্রতীকটি। এমনকি প্রায়শই পরম শত্রু পশ্চিমাদের ব্যঙ্গচিত্রে উদ্ভূত হয় শক্তিমান, হিংস্র এ প্রাণীটি। প্রাণীপ্রেমী রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রিয় পশুও বাদামি ভাল্লুক। প্রাণীটির এক বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিল রয়েছে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রনায়ক পুতিনের। শত্রুদের প্রতি রুশ প্রেসিডেন্টের প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব যেন তাই প্রমাণ করেছে বারবার।
শিকারির গুলিতে সঙ্গী হত্যা বা আবাস উজাড়ের প্রতিশোধ নিতে কখনও কখনও উন্মত্ত হলেও বাদামি ভাল্লুক আদতে অত্যন্ত বন্ধুবৎসল প্রাণী। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন যেন ঠিক বিপরীত। শত্রুর জন্য তার অভিধানে ক্ষমা নামক কোনো শব্দ নেই। ক্ষেপণাস্ত্রে বিদ্ধ করে অথবা তেল-গ্যাসের যোগান বন্ধ করে শত্রুদের ওপর এক হাত নিয়েছেন পুতিন। ভিনদেশে পালিয়ে যাওয়া শত্রুকে ঘায়েল করেছেন নার্ভ গ্যাস প্রয়োগে করে।
বিজ্ঞাপন
ইয়েলৎসিনের ‘পাপ মোচন’
সাল ১৯৯৪। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনে ধুঁকছে নব্য রাশিয়ান ফেডারেশনের অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র সফর করে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হাতে দেশকে সঁপে দিয়ে আসেন রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন। সফরে ক্লিনটন যখন পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো জোট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা উত্থাপন করেছিলেন মার্কিন অর্থ সহায়তার আশায়, রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন আপত্তিও করেননি।
তৎকালীন এক গৌণ সরকারি কর্মকর্তা ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য যা ছিল গভীর অপমান। এ ঘটনা কখনই ভুলে যাননি সদ্য কেজিবি এজেন্ট হিসেবে কর্মজীবন শেষ করে সেন্ট পিটার্সবার্গের ডেপুটি সিটি অফিসারের দায়িত্ব নেওয়া পুতিন।
বিজ্ঞাপন
২০০০ সালের ১ জানুয়ারি রুশ দ্যুমার (রাশিয়ার পার্লামেন্ট) অধিনায়কের চেয়ারে অধিষ্ঠিত হন ‘রাশিয়ান ভাল্লুক’। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এ নামেই তাকে সম্বোধন করে প্রায়ই। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই রাশিয়ান সৈন্যদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। বলেন, তাদের লক্ষ্য ‘রাশিয়ার সম্মান ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা”।
২০০৪ সালেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন অভিযোগ তুলে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের। সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর নির্বাচন প্রভাবিত করে ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ফাঁদ পাততে শুরু করেন পুতিন।
২০০০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯২ জন রুশ এজেন্ট গুপ্তহত্যায় নিহত বা গুরুতর আহত হয়েছেন। যার মধ্যে অন্তত বিশটি ঘটনায় রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির সংযোগ রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
দুই দশকের শাসনামলে পুতিনের ফাঁদ কার্যকর বলেই প্রমাণ হয়েছে। বেলারুশ, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, মালদোভা, আর্মেনিয়া এবং কিরগিজস্থানের মতো সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে মস্কোপন্থী সরকার রয়েছে। ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে পুতিনের প্রতি সমর্থন একাধিকবার সরব হয়েছে দেশগুলো।
পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি তালিকায় যুক্ত করেছে আজারবাইজান, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং নরওয়ের মত রুশ সীমান্তবর্তী দেশগুলোকে। একুশ শতকের পর থেকে মস্কোর রাজনৈতিক উত্থান যেন ইয়েলৎসিনের ‘পাপ মোচন’।
ইয়েলৎসিনের ‘পাপ মোচন’ অভিযানে রুশ সামরিক আগ্রাসনের শিকার হয়েছে শুধুমাত্র ইউক্রেন। মস্কো থেকে মাত্র ১১৬১ কিলোমিটার দূরে ইউক্রেনকে বাগে আনতে রক্ত ঝরিয়েছেন পুতিন। তুখোড় রাজনৈতিক চরিত্র পুতিনের সমরনীতির কাছে খাবি খাচ্ছে পশ্চিমারা।
বিদেশে বিরোধী দমন
দীর্ঘ দুই দশকের শাসনে পুতিনের বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়েছে হাজার হাজার চরিত্র। তবে তাদের কারও ভাগ্যে মেলেনি রুশ প্রেসিডেন্টের অনুকম্পা। ২০১৮ সালের মার্চে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট বনে যাওয়া রুশ সামরিক কর্মকর্তা সের্গেই স্ক্রিপাল এবং তার মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপালের ওপর তেজস্ক্রিয় নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করে রুশ গোয়েন্দারা।
যুক্তরাজ্যের সলসেবেরিতে আশ্রয় নেওয়া বাবা-মেয়েকে নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগের পর পুতিনের প্রতিশোধের স্পৃহা দেখে হতবাক হয়ে যায় বিশ্ব। কারণ সের্গেই স্ক্রিপাল ছিলেন পুতিনের এক সময়ের বন্ধু। সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থায় দুজনেই গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন। এ ঘটনার পর থেকে পশ্চিমারা আঁচ করতে পারেন বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি পুতিনের মনোভাব।
২০০০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯২ জন রুশ এজেন্ট গুপ্তহত্যায় নিহত বা গুরুতর আহত হয়েছেন। যার মধ্যে অন্তত বিশটি ঘটনায় রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির সংযোগ রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
সর্বশেষ ২০২০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আলেক্সি নাভালনির ওপর প্রয়োগ করা হয় ভয়ঙ্কর নভিচক গ্যাস। দীর্ঘদিন জার্মানি চিকিৎসা গ্রহণের পর দেশে ফিরলে তাকে গ্রেফতার করে রুশ পুলিশ।
মার্কিন নির্বাচনে পুতিনের ‘কারিকুরি’
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনে পর্দার পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ৯৪’এ বরিস ইয়েলতসিনের ওয়াশিংটন সফরের চরম অপদস্থ হতে হয়েছিল দেশটিকে। গুরুত্বপূর্ণ ভূমি আলাস্কা ও যুগোস্লাভিয়াসহ বিশাল সোভিয়েত সাম্রাজ্যে কখনও কূটনৈতিক বা সামরিক হস্তক্ষেপ চালিয়েছিল ওয়াশিংটন।
২৬ বছর পর ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এর প্রতিশোধ নেন ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনের পরপরই রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠলে তদন্ত শুরু করে মার্কিন প্রশাসন। হস্তক্ষেপের ঘটনায় ১৩ রুশ নাগরিককে অভিযুক্ত করে মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই)।
মস্কো এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও তদন্তকারী বিশেষ কর্মকর্তা রবার্ট মুলারের দাবি তার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সেন্ট পিটারসবার্গভিত্তিক ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সিকেও অভিযুক্ত করা হয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আর্থিক জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত করার অভিযোগে।
ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ছিলেন বলেই হয়ত নির্বাচনে হস্তক্ষেপের বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী হয়েছিলেন পুতিন। হয়ত তার উত্তরসূরি ইয়েলৎসিনকে অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছেন পুতিন।
সূত্র: পলিটিকো, পুতিন্স রিভেঞ্জ, ন্যাটো, পনার্স ইউরেশিয়া
টিএম