শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কর্মী সংকটে জার্মানি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:১৭ পিএম

শেয়ার করুন:

কর্মী সংকটে জার্মানি

ভারি শিল্প থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কিংবা গৃহস্থালি কর্মকাণ্ড, জার্মানির যে খাতের কথাই বলা হোক, কম-বেশি সবখানেই এখন কর্মী সংকট চলছে। বিদেশি কর্মী আকর্ষণে সরকারের দিক থেকে দেশটির অভিবাসন আইন সংস্কারের উদ্যোগও চলছে।

জার্মানির কোনো রেস্টুরেন্টে এখন খেতে গেলে সহজে টেবিল খালি পেলেও, খাবার পরিবেশনকর্মী বা রাঁধুনির দেখা পাওয়া কঠিন হতে পারে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটির কর্মী সংকটে থাকা খাতের মাত্র একটি উদাহরণ এটি।


বিজ্ঞাপন


সাম্প্রতিক সময়ে জনবল ঘাটতির প্রভাবে রেল ও বিমানের সময়সূচিতেও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে৷ ব্যবসায়ীদের সংগঠন জার্মান চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক জরিপে প্রায় ৫৬ শতাংশ কোম্পানি কর্মী ঘাটতি থাকার কথা জানিয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা তাদের ব্যবসার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে এই পরিস্থিতিকে।

জার্মানির কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মসংস্থান সংস্থা জানিয়েছে, চাকরিক্ষেত্রে ১২২টি খাত এখন ঝুঁকিতে আর ১৪৮টি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু খাতে চাইলেও দ্রুত পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব নয়। যেমন, বয়স্ক ও অসুস্থদের সেবাকেন্দ্রগুলোতে খালি স্থান পূরণে আট মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। নির্মাণ খাতে এই অপেক্ষার সময় ছয় মাস। এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশব্যাপী ১৭ লাখের বেশি কর্মখালি আছে।

কঠিন পরিস্থিতিতে শিল্প
‘পাঁচ-দশ বছর আগে আমরা সেবা দেয়ার বিজ্ঞাপন দিতাম। এখন আমরা সব মাধ্যমে কর্মী আকর্ষণের বিজ্ঞাপন দিচ্ছি,’ পরিস্থিতি কতটা খারাপ সেটি বোঝাতে এমনটি বলেছেন বাডেন-ভ্যুর্টেমবার্গ রাজ্যের প্রতিষ্ঠান আইডিএস-এর পরিচালক মার্কুস ভিন্টার এমন কথা বলেন।

৭৫০ জন কর্মীর এই কোম্পানিতে ২০টি পদ খালি আছে৷ এর মধ্যে তালার মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি কিংবা ভারি যন্ত্র চালানোর মতো লোকও তাদের দরকার।


বিজ্ঞাপন


ভিন্টার বলেন, ‘সমস্যাটা এখন আর কোনো নির্দিষ্ট খাতে নয়, বরং সবক্ষেত্রেই কর্মী সংকট চলছে। এমনকি অদক্ষ কর্মীর পদও খালি থাকছে। শিল্পে এমন সব খাতে লোক দরকার, যাদের ছাড়া কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন।’

অবসরে ‘শিশু বিস্ফোরণ’ প্রজন্ম
ন্যুরেমবার্গের দ্য ইনস্টিটিউট ফর এমপ্লয়ম্যান্ট রিসার্চ (আইএবি)-র অধ্যাপক হার্বার্ট ব্র্যুকারের মতে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা বাদ দিলে এই পরিস্থিতি যে ঘটবে তার পূর্বাভাস মোটামুটি আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন যে নাটকীয় পরিস্থিতিতে পড়েছি, তা দীর্ঘ সময় আগে থেকেই দেখতে পেয়েছি।’

বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জার্মানিতে প্রতি বছর সাড়ে তিন লাখ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটিতে জন্মহার ব্যাপক বৃদ্ধি হয়৷ ওই সময় জন্ম নেয়াদের ‘শিশু বিস্ফোরণ’ প্রজন্ম হিসেবে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এই প্রজন্ম চাকরি থেকে অবসর নিচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে জন্মহার কমে যাওয়ায় তাদের খালি স্থান পূরণ করার মতো এখন যথেষ্ট তরুণ জনগোষ্ঠী নেই দেশটিতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ শ্রম বাজারে ৭০ লাখ কর্মী ঘাটতি থাকবে।

ব্র্যুকার জানান, একটা সময় জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশ থেকে কর্মী এনে নিজেদের চাহিদা মেটাতো। কিন্তু এখন সেসব দেশেও কর্মী ফুরিয়ে আসছে। তিনি বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলোরও আয় বেড়েছে এবং তাদেও জনমিতিতেও পরিবর্তন এসেছে। বলতে গেলে উৎসব পর্ব শেষ হয়ে গেছে।’

সমস্যা শ্রম আইনে
শ্রম বাজারের কর্মী সংকট মেটাতে শ্রম বিশেষজ্ঞ ও শিল্প উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশি কর্মী আনার উপর জোর দিয়ে যাচ্ছেন। এক হিসাব অনুযায়ী, চাহিদা মেটাতে জার্মানিতে এখন বছরে চার লাখ বিদেশি কর্মী প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হলো দেশটির শ্রম আইন অভিবাসীদের আসার জন্য যথেষ্ট সহায়তামূলক নয়। এ কারণে ২০২০ সালে নতুন আইন পাস করে সরকার। কিন্তু এর পরের বছরে মাত্র ৩০ হাজার জনকে নিয়োগ দিয়ে জার্মানিতে আনা সম্ভব হয়েছে, যা হতাশাজনক বলে মনে করেন ব্র্যুকার।

জার্মানির সরকার এখন নতুন আইনটি সংস্কার করতে চায়। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এর মূল রূপরেখাটি তৈরি হতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রস্তাব আসতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হলো, স্বীকৃত সনদ না থাকলেও শুধু চুক্তিপত্রের ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ দেয়ার অনুমতি দেয়া। এর ফলে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোই তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের জন্য প্রস্তুত করে নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজার এবং শ্রমমন্ত্রী হুবার্টাস হেইল।

আইডিএস পরিচালক ভিন্টার বলেন, ‘কোনো একটি কোম্পানির জন্য কে যোগ্য, সেটি এখন নির্ধারণ করে রাজ্য। কিন্তু সেটা তাদের কাজ নয়।’

তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো এখনই অপ্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে চাকরিরত অবস্থায় শিখতে সহযোগিতা করছে। এই সংখ্যাটি প্রায় ২০ শতাংশ বলে জানান ভিন্টার। জার্মানির চেম্বার অব কমার্স এক বিবৃতিতে বলেছে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেরই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জার্মানির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ জার্মানির মতো এত জটিল ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া সবাই সব সময় অনুসরণ করে না। আর এ কারণে বিদেশ থেকে যথেষ্ট কর্মী আনাও সম্ভব হচ্ছে না।

কঠোর ভিসা প্রক্রিয়া
কেউ চাকরির নিয়োগপত্র পাওয়ার পরও জার্মান দূতাবাসের ভিসা প্রক্রিয়া তার জন্য বড় ঝক্কির বিষয় হয়ে উঠতে পারে৷ আইনজীবী বেটিনা অফার বলেন, ‘আমি অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পেয়েছি কর্তৃপক্ষ এমন একটি সন্দেহজনক মনোভাব পোষণ করে যেন নিয়োগকর্তারা তাদের কর্মী আনার বদলে কোনো বিদেশিকে পাচার করতে চাইছে।’ তিনি জার্মানির অভিবাসন কার্যালয়গুলোর এই ‘রক্ষণশীল’ মনোভাবের কড়া সমালোচনা করেন।

অফার বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টান্তমূলক বদল দরকার৷ আমাদের দেশে আনা প্রত্যেক কর্মী আমাদের জন্য এক একটা বিজয়।’ 

শরণার্থীদের কাজে লাগানো
অনেক নিয়োগকর্তা শরণার্থী নীতিতে বদল এনেও পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন চান। ভিন্টার ২০১৬ সাল থেকে তার প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ৩০০ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটিও খুব একটা সহজ ছিল না তার জন্য।

তিনি বলেন, ‘আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, এটা সহজ না৷ দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রথম পর্যায়ে আমাদের কাছে পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারত না। এখানেও আমাদের কিছু পরিবর্তন দরকার।’

সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর