সালটা ২০১১। নিখোঁজ হয়েছিলেন ভারতের রাজস্থানের এক স্বাস্থ্যকর্মী। তার নাম ভঁওরী দেবী। কিন্তু সময় যত এগিয়ে যেতে থাকে, একের পর এক জট খুলতে থাকে। অর্থলোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, রাজনীতি, যৌনতা, কূটনীতি— সব কিছু একই সুতোয় বাধা পড়তে শুরু করে। পুলিশের সঙ্গে তদন্তে জুড়ে যায় সিবিআই এবং এফবিআই-ও।
ভঁওরী দেবী রাজস্থানের অজমের জেলার কিষানগঢ় ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন। ছোট থেকেই অর্থাভাবে দিন কাটিয়েছেন ভঁওরী। বাবা-মা দু’জনেই দিনমজুরি করতেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর বিয়ে করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
তার স্বামী অমরচাঁদ পেশায় ছিলেন গাড়িচালক। বিয়ের পর জোধপুর জেলার অন্তর্গত জালিওয়াড়া গ্রামে থাকতে শুরু করেন ভঁওরী। অমরচাঁদের স্বল্প বেতনে সংসার চলত না। পেটের দায়ে স্বাস্থ্যকর্মীর পেশায় যুক্ত হন ভঁওরী। কিন্তু নিয়মিত কাজে না আসার কারণে চাকরি হারাতে হয় তাকে।
ঠিক তখনই তার জীবন অন্য পথে মোড় নেয়। রাজস্থানের দু’মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন ভঁওরী। তিনি অনুরোধ করেন, তাকে যেন চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যে ক্ষমতার মারপ্যাঁচ বুঝে যান তিনি।
মন্ত্রীদের সান্নিধ্যে ভঁওরী নিজের পছন্দমতো জায়গায় তার কাজ ফিরে পান। শুধু তা-ই নয়, আরও অনেককে কাজ পাইয়েও দিয়েছিলেন তিনি। চাকরি পাওয়ার পর ভঁওরীর জীবনধারায় পরিবর্তন আসায় তা অমরচাঁদের নজরে পড়ে।
বিজ্ঞাপন
প্রচুর সোনার গয়না, বাড়ি, গাড়ি কিনতে শুরু করেন তিনি। তারা দু’জন যে বেতন পান, তা মিলিয়ে এত খরচ করা সম্ভব নয়। অমরচাঁদ তার স্ত্রীকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান ভঁওরী।
তার স্বামী রাজস্থানের দু’নেতা মহীপাল মাদের্না ও মলখন সিংহ বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। অমরচাঁদ নিশ্চিত ছিলেন, তার স্ত্রীর নিখোঁজ হওয়ার পিছনে এ দু’মন্ত্রীই দায়ী। রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় রাজ্য পুলিশ তদন্তের দায়িত্বভার দেয় সিবিআইকে।
সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে জানা যায়, ভঁওরী ২০১৩ সালে ভোপালগড় কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়াতে চাইছিলেন। তার জন্য মন্ত্রীদের ভয়ও দেখাচ্ছিলেন তিনি। দু’মন্ত্রীর সঙ্গেই তার শারীরিক সম্পর্ক ছিলো।
তিনি হুমকি দেন, তাকে যদি ভোটে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া না হয়, তা হলে ভঁওরী এ সম্পর্কের কথা ফাঁস করে দেবেন। শুধু তা-ই নয়, কেঁচো খুঁড়তে কেউটেও বের করে আনলেন সিবিআই কর্মকর্তারা।
ভঁওরীর সঙ্গে নেতা মলখনের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ছিলো। ভঁওরীর ছোট মেয়ের বাবা ছিলেন মলখন। ওই কথা তত দিন গোপন করে রেখেছিলেন দু’জনেই। কিন্তু ভঁওরী তার কাছে দাবি করেন, মলখন যেন তাদের সম্পর্কের কথা জনসমক্ষে স্বীকার করেন। এমনকি, তাদের মেয়ের বিয়ের জন্য ৫০ লাখ টাকা এবং ২০ কেজি সোনার গয়না দিতে হবে বলে দাবি করেন তিনি।
কথাবার্তা রেকর্ড করে এক টিভি চ্যানেলকে ভঁওরী তার নিজের কাছে থাকা একটি সিডি থেকে ভিডিও ফুটেজ পাঠান। স্পষ্ট করে মুখ দেখা না গেলেও চিনতে অসুবিধা হয় না ছবিতে ভঁওরীর সঙ্গে উপস্থিত ব্যক্তিটি মলখন।
পরে ভঁওরীর সঙ্গে চুক্তি করা হয়, সিডি ফেরত দিলে তাকে ৫০ লাখ টাকা বাবদ একটি সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা মূল্যের গাড়ি দেওয়া হবে।
ভঁওরী মন্ত্রীদের শাগরেদের কাছ থেকে টাকা নিতে গেলে তখনই তাঁকে খুন করেন মলখন-মহীপালের লোক।
জানা যায়, প্রমাণ লোপাট করার জন্য খালের কাছে ভঁওরীকে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ লাশের তল্লাশি চালালে রাজীব গাঁন্ধী খালের সামনে কিছু সোনার গয়না, হাতঘড়ি, জামার ছেঁড়া টুকরো, মাথার খুলি, ভাঙা দাঁতের টুকরোর সঙ্গে একটি ক্রিকেট ব্যাট এবং পিস্তলও পড়ে থাকতে দেখা যায়।
ভঁওরীর মেয়ে জামা ও গয়না দেখে নিশ্চিত করে যে এগুলো তার মায়ের। পুলিশ, সিবিআই-এর মিলিত প্রয়াসে ভঁওরীর খুনের সঙ্গে জড়িত ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
ওই সময় রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন অশোক গহলৌত। ভঁওরী দেবীর হত্যাকাণ্ডে নাম জড়ানোয় মলখন ও মহীপাল দু’জনকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেন। ভঁওরীর তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনা-সহ সব খরচ চালানোরও দায়িত্ব নেন মুখ্যমন্ত্রী।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
এমইউ

