শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

মরছে ভূ-স্বর্গের উলার লেক, বাঁচার লড়াই তীব্র হচ্ছে কাশ্মিরিদের

নাছরিন আক্তার
প্রকাশিত: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:০৬ পিএম

শেয়ার করুন:

মরছে ভূ-স্বর্গের উলার লেক, বাঁচার লড়াই তীব্র হচ্ছে কাশ্মিরিদের

বাতাসের ভেলায় ভাসছে স্বচ্ছ মেঘমালা। সঙ্গে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড হিমালয়। আর তার ঠিক মাঝখানেই হ্রদের জলে ভাসছে টগবগে পদ্ম ফুল। সৌন্দর্য তো বটেই, এশিয়ার বৃহত্তম হ্রদগুলোর মাঝেও অত্যন্ত সুপরিচিত এই লেক।

বলছি, জম্মু-কাশ্মিরের বান্দিপোরা জেলার হিমালয় ঘেরা উলার লেকের কথা। ঝিলাম নদীর জলধারা থেকে উৎপন্ন এই হ্রদ প্রাচীন কালে মহাপদ্মেসর নামেও পরিচিত ছিল। লেকটির আশপাশে রয়েছে ৪০টি গ্রাম। যেখানে ৩২ হাজারেরও বেশি মানুষের বসবাস। সৌন্দর্য তো বটেই, মাছ ও জলীয় খাদ্যে ভরপুর ভূ-স্বর্গের এই লেকটি।


বিজ্ঞাপন


উলার লেকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। ছবি: সংগৃহীত

পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল হিসেবেও উলার লেকের ব্যাপক পরিচিত আছে। তাইতো প্রতিদিন হাজারও পর্যটক নৈসর্গিক এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন এখানে। পাশাপাশি উলার লেক মাছে ভরপুর। সেই সঙ্গে লেকজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ওয়াটার চেস্টনাট, শালুক ও বিভিন্ন পশুখাদ্য।

ভূ-স্বর্গের এই লেককে ঘিরেই আশপাশের অঞ্চলের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাশ্মিরিরা এই লেককে ঘিরেই টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। এক কথায় বলা চলে- বেঁচে থাকার জন্য কাশ্মিরিরা এই লেকের ওপরই নির্ভরশীল।

রাতভর নৌকায় ভেসে উলার লেকে মাছ শিকার করেন লেকেরপাড়ের বাসিন্দারা। ছবি: আল-জাজিরা

মধ্যরাত থেকে মৎস্যজীবীরা নৌকায় চড়ে জাল হাতে লেকে নেমে পড়েন। মাছ ধরেন, সেই সঙ্গে সংগ্রহ করেন চেস্টনাট-শালুক। পুরুষ মৎস্যজীবীদের মতো নারীরাও লেকে ভেসে ভেসে মাছ ধরেন। পরে সকালে সবাই ভিড় করেন বাজারে। রাতভর জালে ও হাতে শিকার করা মাছ-চেস্টনাট বিক্রি করে ঘরে ফেরেন তারা। এ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই দিনাতিপাত করেন উলার লেকের পাড়ের বাসিন্দারা।

মেঘালয় ঘেরা হ্রদ উলার লেক। ছবি: সংগৃহীত

প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই লেককে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও গেল কয়েক বছরে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। মিঠা পানির এ লেকে যেন শকুনের চোখ পড়েছে, দূষণ-দখলে মরতে বসেছে লেকটি। সেই সঙ্গে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থেও কমে লেকটি ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।

১০০ বছরে লেকটির আয়তন বর্তমানে অর্ধেকে নেমেছে। বন্যায় লেকের পাড় উপচে তলিয়ে যাচ্ছে লোকালয়। এতে বিলুপ্ত হচ্ছে শত শত প্রজাতির মাছ। সঙ্গে জলীয় খাদ্যের দেখাও মিলছে কম। অনেক সময় রাতভর নৌকা-জাল নিয়ে লেকে ঘুরেও খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে জেলেদের।

৪৫ বছর বয়সী হাজরা বেগম লেকপাড়ের লঙ্কেশপোরা গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় তিনি মৎস্যজীবী। মধ্যরাতে পরিবারের অন্য সদস্যরা যখন গভীর ঘুমে, ঠিক তখনি বেরিয়ে পড়েন হাজরা। নৌকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা উলার লেকে ভেসে বেড়ান তিনি। মাছ ধরেন, চেস্টনাট সংগ্রহ করেন। রাতভর যে মাছ ধরতে পারেন, সেটাই বাজারে বিক্রি করে ঘরে ফেরেন হাজরা।

উলার লেকপাড়ের বাসিন্দা হাজরা বেগম। ছবি: আল-জাজিরা

কয়েক বছর আগেও হাজরা বেগম নৌকাভর্তি চেস্টনাট ও অনেক মাছ নিয়ে ফিরতেন। কঠোর পরিশ্রম করলেও লেক থেকে যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার চালানো সহজ ছিল। তবে বর্তমানে লেকে মাছ ও চেস্টনাট দুটোই কমেছে। ফলে রাতভর কষ্ট করেও অনেকটা খালি হাতে ফিরছেন হাজরা।

লেকপাড়ের এই নারী জানান, রোজ রাত ৩টায় বাড়ি থেকে বের হন তিনি। রাতে শেষভাগে নৌকায় ভেসে উলার লেকে মাছ ধরেন। চেস্টনাট তোলেন। সকালে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। আগে এ কাজ করে দিনে ৩০০-৫০০ রুপি আয় হতো। এখন ২৫০-২৮০ রুপির বেশি আয় করা কঠিন।

হাজরার মতো আরেক নারী মৎস্যজীবী আয়েশা বেগম। তিনি বলেন, ‘আগে আমরা ভালো উপার্জন করতাম। প্রতিদিন অনেক পরিমাণে মাছ ধরতাম। চেস্টনাট তুলতামও অনেক। কিন্তু পলিথিন ও ড্রেনেজ বর্জ্যে লেক এখন ব্যাপকভাবে দূষিত। চেস্টনাট ও মাছ দুটোই কমেছে। আগের চেয়ে ৭০ ভাগ কম মাছ ধরতে পারি। এমন অমূল্য সম্পদ আমরাই নষ্ট করছি। আমরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি।’

স্বচ্ছ পানির লেক এখন ‘রোগ বিস্তারের উৎস’

উলার লেক মিঠা পানিতে ভরা। আয়নার মতো স্বচ্ছ ছিল এই লেকের পানি। নির্বিঘ্নে পান করতেন এলাকার বাসিন্দারা। তবে এখন খাওয়া তো দূরের কথা, লেকের পানি শরীরে লাগলেই ছড়াচ্ছে রোগ-জীবাণু। এক সময়ের স্বচ্ছ পানির লেকটি এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে রোগ বিস্তারের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাত্রাধিক বর্জ্য ফেলায় লেকটি এখন রীতিমতো দূষিত।

মাত্রাধিক বর্জ্য ফেলায় উলার লেক এখন রীতিমতো দূষিত। ছবি: আল-জাজিরা

এই দূষণের ফলে তীব্র স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন মৎস্যজীবীরা। দীর্ঘ সময় লেকে নৌকায় চড়ে মাছ ধরা ও চেস্টনাট সংগ্রহের কাজ করায় নানান ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সেই সঙ্গে সংক্রামক এসব রোগ ছড়াচ্ছে দ্রুত। কারও মুখে ঘা হচ্ছে, হাতে-পায়ে ফোসকা পড়ছে। ছত্রাকজনিত রোগের সংক্রমণও বাড়ছে। পাশাপাশি শরীরের তীব্র ব্যথার সমস্যায়ও ভুগছেন অনেকে।

উলার লেকের মাছ ও চেস্টনাট বিক্রি করে হাজরা বেগমের দৈনিক আয় ২৫০-২৮০ রুপি। ছবি: আল-জাজিরা

হাজরা বেগম বলেন, ‘ত্বকে ফুসকুড়ি পড়ে। ছত্রাকের সংক্রমণে আক্রান্ত হই। প্রায়ই হাত ফুলে যায়। শ্বাসকষ্টও হচ্ছে কিছুদিন ধরে। কষ্টের জীবন। তবুও লেক ভালো থাকলে আশা ছিল। তবে লেকও যে মরি মরি অবস্থায়!’

হাজরা বেগমের তিন মেয়ে। সবাই স্কুলে পড়তো। তবে এখন আর তারা স্কুলে যায় না। আর্থিক অনটনে শিক্ষাজীবনের ইতি টেনেছে শিশুরা। তারা এখন মায়ের মাছ ধরা, চেস্টনাট তোলার কাজে সহায়তা করছে। বাজারে পণ্য বিক্রিও করে।

তিনি বলেন, ‘আমরা ঘর থেকে বের না হলে খাবার জুটবে না। আর ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের কাজের উৎস এ উলার লেক। এর বাইরে আয় করার তেমন কোনো পথ নেই। সে জন্য আমরা লেক বাঁচাতে চাই। জীবিকা রক্ষার তাগিদে আমাদের এটা করতেই হবে।’

উলার লেকপাড়ের নারী মৎস্যজীবী ফিরসা বেগম। ছবি: আল-জাজিরা

ফিরসা বেগম নামে আরেক নারী মৎস্যজীবী বলেন, ‘আমি প্রচণ্ড স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছি। লেকের পানি থেকে শরীরে নানান সমস্যা হচ্ছে। তবে কাজ না করে উপায় নেই। মাঝে মাঝে কোনো আয়ই হয় না। তবুও উলার লেকে আমাকে নামতেই হয়।’

সংকুচিত হচ্ছে লেক, আয়তন নেমেছে অর্ধেকে

উলার লেকের বড় অংশে এখন পলি জমেছে। সেই সঙ্গে প্লাস্টিক-পলিথিনে ভরে গেছে লেকের তলদেশ। কঠিন এসব বর্জ্যে ওয়াটার চেস্টনাট, শালুক ও বিভিন্ন পশুখাদ্য জন্মাতে পারছে না। লেকে মাছের খাবার কমছে। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কয়েকশো বছর ধরে এ লেক ভরে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।

২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল উলার লেকের দূষণ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০০ বছরে লেকটি ৪৫ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ১৯১১ সালে লেকটি ৬০ দশমিক ৯ বর্গমাইল দীর্ঘ ছিল। যা ২০০৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৪৮ বর্গমাইল। গেল কয়েক বছর ধরে এ লেকের ঐতিহ্যবাহী কিছু মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও কিছু মাছের প্রজাতিও বিপন্নপ্রায়।

রাতভর উলার লেক থেকে মাছ ও চেস্টনাট সংগ্রহ করে সকালে স্থানীয় বাজারে সেগুলো বিক্রি করেন হাজরা বেগম। ছবি: আল-জাজিরা

বর্তমানে লেক দখল করে প্রভাবশালী অনেকেই ফসল ফলাচ্ছেন। অনেকে আবার গাছ লাগাচ্ছেন। দখলের ক্ষেত্রে একটি গোষ্ঠী সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তারা পর্যটক আকর্ষণের জন্য লেকের ভেতরে অবৈধভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করছেন। এতে লেকের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি নষ্ট হচ্ছে। সেই সঙ্গে লেকজুড়ে পলিথিন-প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়ছে। এতে পানি ধারণ ক্ষমতাও কমছে লেকে।

মৎস্যজীবীরা বলছেন, এ লেকটি শুধু জীবিকা নির্বাহের জন্যই নয়। উলার লেক তাদের বন্যা থেকে বাঁচায়।

উলার লেক থেকে মাছ শিকার করে এভাবেই স্থানীয় বাজারে সেগুলো বিক্রি করেন লেকপাড়ের মৎস্যজীবীরা। ছবি: আল-জাজিরা

এদিকে, গবেষকরা বলছেন- লেকের স্বাদুপানির বড় অংশ কৃষি জমিতে ব্যবহার হয়। ফলে ফসল উৎপাদনেও এ লেকের পানি গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে, উলার লেকে মাছ ও চেস্টনাট কমে যাওয়া জেলেরা অন্য কাজের সন্ধানে ছুটছেন। তবে অনেকেই জানাচ্ছেন, বৃদ্ধ বয়সে তারা আর কোথাও তেমন কাজ দেখছেন না। বাধ্য হয়ে তাদের এ পেশাতেই থাকতে হচ্ছে। ফলে সামনের দিনে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াইয়ের শঙ্কায় উদ্বিগ্ন ৪০ গ্রামের বাসিন্দারা।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা।

এনএইউ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর