বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ভারতে চাকরিতে বৈষম্যের শিকার মুসলিম নারীরা: সমীক্ষা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ আগস্ট ২০২২, ০২:২৫ পিএম

শেয়ার করুন:

ভারতে চাকরিতে বৈষম্যের শিকার মুসলিম নারীরা: সমীক্ষা

ভারতে চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন মুসলিম নারীরা। একই ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও তাদেরকে নিয়োগে পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ মিলেছে একটি সমীক্ষায়। লেডবাই নামের ফাউন্ডেশন গত জুনে এই সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করে।

২৮ বছর বয়সী লুবনা আমির একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডেন্টিস্ট। কিন্তু পেশাগত অনুশীলন তার কাছে এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্রের একটি সরকারি কলেজে দন্তচিকিৎসা এবং কয়েক বছর অনুশীলন করেছেন তিনি। এখন আরেকটু ভালো অবস্থান চান। 


বিজ্ঞাপন


২০১৮ সালে পুনের এই বাসিন্দা ইমেইলের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন ক্লিনিকে আবেদন করেছেন। এমনকি তিনি কিছু ক্লিনিকে ব্যক্তিগতভাবে সিভি জমা দিয়েছেন। লুবনা বলেন, 'আমি স্থানীয় চেনাশোনাগুলোর বাইরে একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চেয়েছিলাম। প্রায় দুই ডজন আবেদন করে এবং খুব ভালো শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলেও কোনো সাড়া পাইনি।'

তিনি বলেন, 'আমি অনেক ভালো গ্রেড পেয়েছি এবং একটি সরকারি কলেজ থেকে ইন্টার্নশিপ করেছি যা ডেন্টাল শিল্পে অনেক বেশি চাওয়া হয়। আমার কাজের প্রোফাইল ভাল ছিল। তবুও আমি কোনো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছিলাম না।'

মুসলিম নারীরা বেশিরভাগ সময় হিজাবের কারণে অবহেলার শিকার হন। এত আবেদনের পর লুবনা বুঝতে পেরেছিলেন যে তার পরিচয় তাকে একটি অসুবিধায় ফেলেছে। তিনি যদি মুসলিম না হতেন তবে পরিস্থিতি অন্যরকম হত।

india muslim


বিজ্ঞাপন


একটি ডেন্টাল ক্লিনিকে সাক্ষাৎকারের সময় তাকে তার ব্যক্তিগত জীবন এবং বিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। লুবনা জানান, 'তারা যা জিজ্ঞাসা করেছিল আমি তার সব উত্তর দিয়েছি। সাক্ষাৎকারের শেষে, আমাকে আমার হিজাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।'

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী লুবনাকে আগেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি যদি ক্লিনিকে কাজ করেন তবে তার হিজাব খুলতে ইচ্ছুক কিনা। লুবনা এটি করতে অস্বীকার করেছিলেন। এক কর্মকর্তা তাকে পরে জানিয়েছিলেন যে, তাকে তারা নিয়োগ দেওয়া হবে না।

চাকরির জন্য মরিয়া লুবনা ক্লিনিকাল থেকে নন-ক্লিনিক্যাল ফিল্ডে গিয়েছেন। তিনি এখন ক্যান্সার গবেষণায় ফোকাস করে এমন একটি বায়োইনফরমেটিক্স কোম্পানিতে সিনিয়র মেডিকেল ডেটা বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করছেন।

৩২ বছরের শায়লা ইরফান নয়াদিল্লির ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের সবচেয়ে বড় চেইনগুলোর একজন শিক্ষক ছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু প্রশাসনের তরফে হঠাৎ তাকে হিজাব খুলে ফেলার কথা বলা হয়। তারপর তিনি তর্কে না গিয়ে চাকরি ছেড়ে দেন।

শায়লা বলেন, 'তারা বিনয়ের সাথে আমাকে আমার হিজাব খুলে ফেলতে বলেছিল। কারণ ছাত্র এবং শিক্ষকরা এতে অস্বস্তি বোধ করে।'

পরে অন্য স্কুলে গেলেও তাকে হিজাবের কারণে নিয়োগ দেয়া হবে না বলে জানানো হয়। শায়লা বলেন, 'এবার তারা জিজ্ঞেস করল আমি হিজাব খুলে ফেলব কিনা। আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি কারণ আমি এটি অপসারণ করতে অস্বীকার করেছি।'

নিয়োগে পক্ষপাতিত্ব
লেডবাই ফাউন্ডেশনের জুন মাসে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বিভিন্ন সেক্টরে প্রবেশস্তরের চাকরির জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মুসলিম নারীদের প্রতি বৈষম্য ও পক্ষপাতের কথা উঠে এসেছে।

সমীক্ষার 'হায়ারিং বায়াস' অধ্যয়নটি মুসলিম নারীদের প্রতি অত্যধিক নিয়োগের পক্ষপাতিত্বকে হাইলাইট করে। সমানভাবে যোগ্যতা থাকার পারও তারা এমন পক্ষপাতিত্বের শিকার হন।

লেডবাই ফাউন্ডেশন বলছে যে, তারা দুটি সমানভাবে যোগ্য জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করেছে। পার্থক্য ছিল তাদের নামের মধ্যে: মুসলিম প্রোফাইলের জন্য হাবিবা আলি এবং হিন্দু প্রোফাইলের নাম ছিল প্রিয়াঙ্কা শর্মা।

১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে ফাউন্ডেশন দুই নারীর নামে পেশাদার নেটওয়ার্কিং সাইট লিংকড ইনে এক হাজারের বেশি চাকরির আবেদন করে। সেখানে হিন্দু নামের সিভি ২০৮ প্রতিষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া পায়। অপরদিকে মুসলিম নামের সিভি পায় ১০৩টিতে। প্রিয়াঙ্কা শর্মার ক্ষেত্রে সরাসরি ফোন করে যুক্ত হয় ৪১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে হাবিবা আলি পান ১২.৬ শতাংশ ফোন।

লেডবাই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও রুহা শাদাব বলেন, 'আমরা এই গবেষণায় মুসলিম নারীদের শ্রমশক্তির অংশগ্রহণে বাধাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।'

মেরুকরণ
ভারতের ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ মুসলমান। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে এই হারের কোনো চিহ্ন নেই। একাধিক সরকারি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, জনসংখ্যার হিসেবে চাকরির ক্ষেত্রে অনেক নিচে রয়েছে মুসলিমরা। 

indian muslim women

এই কমিশনগুলোর মধ্যে একটির নেতৃত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রাজিন্দর সাচার। ২০০৬ সালে এই কমিশন দেখেছিল যে, ভারতের মুসলমানরা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে সুবিধাবঞ্চিত।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে জনসংখ্যার তুলনায় ২০২১ সালে চাকরিতে মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ১৫ শতাংশের কম, যেখানে হিন্দু নারীদের এই হার ২৭ শতাংশ। বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান নারীদের জন্য এই পরিসংখ্যান ছিল যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ এবং ৩১ শতাংশ।

২০১৪ সাল থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসে। ভারত সরকার মুসলিম সংখ্যালঘু এবং তাদের অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকারকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন নীতি অনুসরণ করেছে।

গভীরভাবে মেরুকরণের শিকার হচ্ছেন ভারতের মুসলিম নারীরা। এ বিষয়ে নয়াদিল্লির শিক্ষাবিদ এবং কর্মী অপূর্বানন্দ বলেন, 'পক্ষপাত সর্বদাই ছিল কিন্তু বিজেপি এবং আরএসএসের আধিপত্যের সাথে, লোকেরা এখন সমস্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে মুসলমানদের বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এটি এখন প্রকাশ্যে করা হচ্ছে।'

অপূর্বানন্দ বলছিলেন যে, 'হিন্দু অধিকারের উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা, তাদের বঞ্চনা এবং ক্রমাগত অভাবের অবস্থায় বাধ্য করা যাতে তারা একটি স্থায়ী অধীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। ধারণাটি এখন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা।'

সূত্র: আল জাজিরা

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর