শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা’

আবুল কাশেম
প্রকাশিত: ১৬ জুলাই ২০২২, ০১:৫৮ পিএম

শেয়ার করুন:

‘সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা’

‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা, (রে ভাই) এই তো বিধির খেলা। সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা’। জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গীতিগ্রন্থ বুলবুল এর দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লিখিত গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়। গানটির প্রায়োগিক বাস্তবতা অনেকটা মিলে যায় বর্তমান শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। একসময়ে সিঙ্গাপুর-দুবাই-হংকং হতে চাওয়া ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি এখন দেউলিয়া। 

শ্রীলঙ্কাকে উপমহাদেশের সবচেয়ে উন্নত দেশ বলা হতো কয়েকমাস আগেও। মাথাপিছু আয়, উচ্চ জীবনমান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ খাতে উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল সাবেক শীলন। ২০২০ সালে দেশটির জিডিপি ছিল ৩ হাজার ৬৮২ ডলার। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির আকার ছিল $৮১ বিলিয়ন ডলার যা মাত্র দুই বছর আগে ২০১৯ সালে ছিল $৮৪ বিলিয়ন ডলার। ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৪% যা এই অঞ্চলের কোন দেশের ছিল না। তবে সেসবই এখন অতিত। বাস্তবতা থেকে কঠোর শিক্ষা নিচ্ছে সিংহলিরা।


বিজ্ঞাপন


রাজধানী কলোম্বোর বুকে সবুজ ডাটার মাথায় ফুটে রয়েছে একটি লাল পদ্ম। নিলাম কুলুনা (লোটাস টাওয়ার) নামের ১১০০ ফুট উঁচু টাওয়ারটিতে রয়েছে বিলাসবহুল হোটেল রুম, শপিং মল, ডিজিটাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কসহ নানা দর্শনীয় স্থাপনা। দশ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত টাওয়ারটির খরচ যোগায় চীন। এটিকে পারিবারিক শাসনের গৌরবের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন রাজাপাকসে পরিবারের অন্যতম সদস্য দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে।

তবে বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা নিলাম কুলুনা এখন অনেকটা মৃত্যুপুরী। সবুজ ডাটা আর লাল পদ্মের আভাও কমে এসেছে। এই প্রতীকই এখন দেশটির অসহায়ত্বের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর টাওয়ারটিকে দেখা হচ্ছে তাদের সময়ে নেয়া অনেক অযৌক্তিক শ্বেতহস্তী প্রকল্পের অন্যতম হিসেবে।

sri lanka port city
সাগর ভরাট করে নির্মাণ হচ্ছে পোর্ট সিটি কলম্বো

শ্রীলঙ্কার আরও একটি বিলাসবহুল প্রকল্প হলো সাগর ভরাট করে নতুন এক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা। ১৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে পোর্ট সিটি কলম্বো নামে সম্পূর্ণ নতুন এক শহর। নির্মীয়মাণ অঞ্চলটি আয়তনে লন্ডনের মধ্যভাগের সমান। রয়েছে হাম্বান্টোটা সমুন্দ্রবন্দরও। এই দুই প্রকল্পেও মূল অর্থায়ন করছে চীন। ভবিষ্যতে দুবাই ও হংকংয়ের মতো পোর্ট সিটি কলম্বো এশিয়ার অন্যতম বড় আর্থিক হাব হয়ে উঠবে বলে দাবি করে রাজাপাকসে পরিবার। নকশাও হয়েছে সেভাবে। সেই প্রকল্প এখন ঘোর অন্ধকারে। প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ শঙ্কায়। সমালোচকরা বলছেন, প্রকল্পটি থেকে শ্রীলংকার লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।


বিজ্ঞাপন


রাজাপাকসেদের গৃহীত উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে নিজ জেলা হাম্বানটোটার মাত্তালা রাজাপাকসে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। প্রায় ২৭ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত বিমানবন্দরটি এক প্রকার পরিত্যক্ত। কারণ সেখানে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করে মাত্র একটি করে এয়ারলাইন্স। এছাড়া জনবহুল এলাকা থেকে বেশ দূরের এই এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার আসনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। যা বিয়ে-অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দিতে চাইলেও বেশিরভাগ সময় লোক মেলে না।

বিশ্লেষকদের মতে, হাম্বানটোটার প্রকল্পগুলো হাতে নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের উন্নয়ন নীতি ‘গড়ে তুললেই মানুষ আসবে’ অনুসরণ করেছিলেন রাজাপাকসেরা। কিন্তু মাত্তালার ক্ষেত্রে এ নীতি কাজে আসেনি। অঞ্চলটিকেও পর্যটকদের জন্য তেমন একটা আকর্ষণীয় করা যায়নি।

প্রায় দুই দশক শ্রীলঙ্কাকে শাসন করেছে রাজাপাকসে পরিবার। এ সময় দেশটিতে উচ্চাভিলাষী ও ব্যয়বহুল অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে দিন শেষে এর কার্যকারিতা মিলেছে সামান্যই। আর বৈদেশিক ঋণের বোঝা বেড়ে আমদানিনির্ভর দেশটির রিজার্ভ থেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে। 

rajapaksa
মাহিন্দা ও গোতাবায়া রাজাপাকসে

এছাড়া জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা চা শিল্প ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। শক্তিশালি এক স্তম্ভ পর্যটন খাতও ধসে পড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকেই ক্ষতি ত্বরাণ্বিত হয় শ্রীলঙ্কার।

এরই মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা। শুরুতে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা, তারপর পরিবারের অন্যান্য মন্ত্রীরা এবং সবশেষে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়তেই হয়েছে গোতাবায়া রাজাপাকসেকে। যে পরিবার এবং রাজনীতিবীদরা শ্রীলঙ্কায় বীরের মর্যাদা পেতেন তাদেরকেই এখন টেনেহিঁচড়ে নামিয়েছেন সাধারণ মানুষ। পদত্যাগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহেও।

এতে শ্রীলঙ্কায় সর্বদলীয় সরকার গঠনের পথ খুলেছে। এ ধরনের সরকার গঠিত হলে তাদের প্রধান কাজ হবে দেশটির অর্থনীতির শৃঙ্খলা ফেরানো, ঋণদাতাদের সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করা। দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে যে অর্থ সাহায্য নিতে চায় সে বিষয়েও আলোচনা এগোবে বলে আশা করা যায়।

পার্লামেন্টের স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে বলেছেন, ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কায় সামনে কী রয়েছে সেটিই এখনো চিন্তার বিষয়। গত মাসে রনিল বিক্রমাসিংহে এক সাক্ষাৎকারে  বলেন, তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে আরও বেশি ছাড়ের তেল কেনার কথা বিবেচনা করবেন, যাতে দেশটির সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়। 

hambantota
হাম্বান্টোটা সমুদ্র বন্দর

দেশটির অর্থনীতিতে বড় ক্ষতি করেছে, এমন নীতিগুলো বাতিল করে আগের নীতিতে ফিরেছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে কর কমানোর বিষয়টি বাতিল করা ও রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করার বিষয়গুলো। তবে এর প্রভাব পড়তে আরও সময় লাগবে।

সংবাদপত্র কলম্বো টাইমস–এর সাম্প্রতিক একটি শিরোনাম ছিল ‘শ্রীলঙ্কার শেষ আশা টিকে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তার ওপর’। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে সহায়তার জন্য সরকার আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। গত ২২ জুন বিক্রমাসিংহে বলেন, চলতি মাসের শেষ দিকে প্রাথমিক চুক্তির বিষয়ে আশা করছেন তিনি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টি নির্ভর করছে বিক্রমাসিংহের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন এবং নতুন সরকার কেমন হবে, তার ওপর।

দেশটিতে রাজনৈতিক দুর্নীতিও একটি বড় সমস্যা। এটি কেবল রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করার ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখে না, এটি শ্রীলঙ্কার জন্য যেকোনো আর্থিক উদ্ধারের পথকেও জটিল করে তোলে। শ্রীলঙ্কার নেতারা ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। কিন্তু এখনো নতুন সরকারের বিষয়ে তারা একমত হতে পারেননি।

একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন এবং তাদের সঙ্গে আইএমএফের কার্যকরী আলোচনা সাময়িকভাবে ট্রাকে ফিরতে সাহায্য করবে শ্রীলঙ্কাকে। তবে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা নিরাময়ে দরকার দীর্ঘ সময় ও স্থায়ী প্রকল্প। দুর্নীতিতে ডুবে থাকা শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার তার কতটুকু করতে পারবে এবং সাধারণ মানুষ কতটা ধৈর্য ধরে সরকারের সঙ্গে থাকবে সেটিই দেশটির যৌবন ফিরে পাওয়ার পথ ও সময় বলে দেবে।

অন্ধকার কেটে যাক সিংহলের। তাদের থেকে শিক্ষা নিক পৃথিবীর সব রাষ্ট্র।

একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর