রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

দিল্লিতে বিয়েতে ওড়ানো টাকা কুড়ানোয় কিশোরকে গুলি করে হত্যা!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

দিল্লিতে বিয়েতে ওড়ানো টাকা কুড়ানোয় কিশোরকে গুলি করে হত্যা

‘রাত ৯টা বাজলেই মনে হয় সাহিল বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কড়া নেড়ে বলছে, আম্মি, দরজা খোলো... আমি চলে এসেছি’। আমি জানি ও আর এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আমার মনে এখনো একটা আশা রয়ে গেছে যে ও বাড়ি আসবে। ওর অপেক্ষায় রাত একটা পর্যন্ত জেগে বসে থাকি’— কথাগুলো বলছিলেন দিল্লির এক মা।

দিল্লির শাহদরার বাসিন্দা এই নারীর নাম নিশা আনসারি। এই প্রথমবার নয়, এর আগেও সন্তানহারা হয়েছেন তিনি। গত পাঁচ বছরে তার দুই ছেলেকে হারিয়েছেন বছর ৪২-এর এই মা। তার বড় ছেলেকে ২০২০ সালে মারাত্মক এক রোগ কেড়ে নিয়েছিল। সেই সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর। দ্বিতীয় ছেলে, সাহিলকে তিনি হারিয়েছেন দিন কয়েক আগে।


বিজ্ঞাপন


অভিযোগ উঠেছে, ভারতের সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (সিআইএসএফ)-এর হেড কনস্টেবল মদন গোপাল তিওয়ারির বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু হয় ১৪ বছরের সাহিলের। সঙ্গে এটাও অভিযোগ উঠেছে, তিওয়ারি এই কারণে গুলি চালিয়েছিলেন যে তার ভাইয়ের বিয়ের বরযাত্রীদের ছড়ানো টাকা নিয়েছিল ১৪ বছরের সাহিল।

প্রসঙ্গত, ভারতসহ অনেক জায়গায় বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে টাকা ছড়ানোর চল রয়েছে।

মদন গোপাল তিওয়ারির পরিবার অবশ্য ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, ওইদিন ‘দুর্ঘটনাবশত গুলি চলেছিল’।

সাহিলের মা নিশা আনসারি বলেছেন, ‘বিয়েতে কেন টাকা ছড়ানো হয়? নেওয়ার জন্যই তো, তাই না? আর সেই টাকাও কিন্তু আসল টাকার নোট ছিল না। নকল টাকার (খেলা বা সজ্জার জন্য টাকার মতো দেখতে নোটের দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি) জন্য আমার ছেলেকে গুলি করল’।


বিজ্ঞাপন


তিনি আরও বলেন, ‘এই ধরনের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। সরকার কি এই জন্য তাদেরকে অস্ত্র দিয়েছে? যদি গুলি করতে হয় তাহলে সীমান্তে গিয়ে সন্ত্রাসীদের নিশানা করে গুলি চালাক। একটা নিষ্পাপ শিশু কী ক্ষতি করেছিল?’

সাহিলের বয়স ১৪ বছর হলেও সংসারের জন্য অর্থ উপার্জন করতে কাজ করা শুরু করেছিল সে। মাস ছয়েক আগে তার বাবা তার শরীরের একাংশে পক্ষাঘাত হওয়ায় বাড়ির হাল ধরার সিদ্ধান্ত নেয় এই কিশোর। বাড়ির কাছেই একটা মুদির দোকানে কাজ শুরু করেছিল সাহিল।

ঘটনার দিন অর্থাৎ, ২৯ নভেম্বর রাতেও কাজ শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল সে, যদিও তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।

বাবা সিরাজুদ্দিন আনসারি বলেছেন, ‘২৯ তারিখ রাত ৯টার দিকে, আমার ছোট ছেলে সাজিম আর তার সঙ্গে আরো দু'জন ছেলে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি আসে। (সাজিম) বলতে থাকে- পাপা সাহিলকে গুলি করা হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম বাচ্চারা মজা করছে। কিন্তু ওরা কাঁদতে কাঁদতে বলল- না ওকে মেরে ফেলেছে’।

শারীরিক কারণে চলাফেরা করতে অসুবিধা হয় আনসারির। তিনি বলেছেন, ‘শারীরিক সমস্যার জন্য আমি ধীরে ধীরে হাঁটি। তাই সাহিলের মা তৎক্ষণাৎ সেখানে দৌড়ে যায়। বাড়ি থেকে একটু দূরে যে কমিউনিটি হল রয়েছে সেখানে মাটিতে ওরা সাহিলকে পড়ে থাকতে দেখে। ওর দেহে আর প্রাণ ছিল ন ‘।

পরিবার জানিয়েছে, ওই রাত্রে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে মদন গোপাল তিওয়ারিকে লক্ষ্য করেছিল সাহিল। বরযাত্রীর সঙ্গে থাকা তিওয়ারি টাকা ছড়াচ্ছিলেন। তার সামনে রাস্তায় পড়ে থাকা টাকা কুড়াতে থাকে ওই কিশোর।

সাহিলের পরিবারের অভিযোগ, এই বিষয়টাই মদন গোপাল তিওয়ারির পছন্দ হয়নি। তিনি প্রথমে সাহিলকে মারধর করেন এবং পরে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালান।

'ছেলেকে দেখে সংজ্ঞা হারিয়েছিলাম'

ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত একটা ভিডিওতে দেখা গেছে, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে সাহিল। তার মাথা থেকে রক্তপাত হচ্ছে।

সাহিলের মা বলেছেন, ‘ওকে দেখামাত্রই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেখানে উপস্থিত একজন প্রতিবেশী আমাকে ধরেন। চোখের সামনে ছেলেটা পড়েছিল। কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি। পরে আমরা ওকে হেডগেওয়ার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ততক্ষণে ওর মৃত্যু হয়েছে।

আনসারি পরিবার আসলে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলার বাসিন্দা। বর্তমানে তাদের বাস দিল্লির শাহদারায়। সেখানকার একটা ছোট্ট চার ফুট বাই চার ফুটে ঘরে সাহিলের পরিবার থাকে।

বাবা সিরাজুদ্দিন আনসারি পেশায় দিনমজুর ছিলেন। কিন্তু ছয় মাস আগে শারীরিক সমস্যার কারণে কমই কাজ করতে সক্ষম তিনি। তাই সংসার চালানোর জন্য নিজেই কাজে যোগ দেয় সাহিল।

সাহিলের সম্পর্কে নিশা আনসারি বলেন, ‘আমার ছেলে একটা পিঁপড়েও মারতে পারত না। আপনি আশেপাশের লোকেদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন- ও কোনোদিন মারামারি, ঝগড়া করেনি। এমনকি গালিও দিতে জানত না ছেলেটা। ও সবসময় চুপচাপই থাকত। লোকে ভাবত ও বুঝি কথা বলতে পারে না।

তিনি আরও জানিয়েছেন, সাহিলের লক্ষ্য ছিল তার বাবাকে সুস্থ করে তোলা। তার কথায়, ‘শুধু একদিকেই মন ছিল ওর- কীভাবে দু'পয়সা রোজগার করতে পারবে যাতে বাবার জন্য ওষুধ কেনা যায়, সংসারের খরচ চালানো সম্ভব হয়’।

সিআইএসএফ-এর হেড কনস্টেবল মদন গোপাল তিওয়ারির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের দাবি জানিয়েছেন নিশা আনসারি।

পুলিশ কী বলছে?

এই ঘটনায় অভিযুক্ত মদন গোপাল তিওয়ারি এখন বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন।

শাহদারার ডেপুটি কমিশনার (ডিসিপি) প্রশান্ত গৌতমের কাছে এই মামলার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছেন, ‘ঘটনার পর অভিযুক্ত ওই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। এই মামলার তদন্তের জন্য সীমাপুরীর এসিপি (অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ) এবং মানসরোবর থানার এসএইচও (স্টেশন হাউজ অফিসার)-এর তত্ত্বাবধানে একটা দল গঠন করা হয়েছিল’।

তিরি বলেন, ‘স্থানীয় ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং যেখানে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতে অভিযুক্তকে পরের দিনই, অর্থাৎ ৩০ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের ইটাওয়া থেকে গ্রেফতার করা হয়’।

ডিসিপি আরও জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্ত গুলি চালানোর কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।

পুলিশ বলছে, তিওয়ারি স্বীকার করেছেন যে ‘বরযাত্রীরা যখন টাকা ছড়াচ্ছিলেন সেই সময় সেখানে উপস্থিত বাচ্চারা শোভাযাত্রার ফেলে দেওয়া নোটগুলো কুড়িয়ে নিতে থাকে। সেই সময় তিনি রেগে যান এবং তাদের মধ্যে একটা বাচ্চাকে নিশানা করে গুলি চালিয়ে দেন’।

পুলিশ আরো জানিয়েছে, গুলি চালানোর জন্য যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা একটা লাইসেন্সপ্রাপ্ত পয়েন্ট থার্টি-টু বোর পিস্তল ছিল।

তবে মদন গোপাল তিওয়ারির ভাই সোনু তার দাদার বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি উত্তর প্রদেশের ইটাওয়ায় বাস করেন।

তিনি বলেছেন, ‘আমার দাদা ইচ্ছে করে গুলি চালায়নি। সবাই (বিষয়টাকে) ভুলভাবে দেখাচ্ছে। বিয়ের বরযাত্রী যাওয়ার সময় ভিড় ছিল, আর ওর পিস্তল লোড করা অবস্থায় ছিল। দুর্ঘটনাক্রমে গুলি চলে এবং বাচ্চার গায়ে লেগে যায়। অনেকে বলছেন যে ও (মদন গোপাল তিওয়ারি) সেই সময় মদ্যপ অবস্থায় ছিল। কিন্তু আপনি ওর পুরো রেকর্ড বের করে দেখুন, ও কখনো অ্যালকোহল স্পর্শ পর্যন্ত করেননি। আমরা একজন আইনজীবী ঠিক করে আইনি লড়াই লড় ‘।

মদন গোপাল তিওয়ারির পরিবার ইটাওয়াতেই বাস করে। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। বর্তমানে তার পোস্টিং ছিল কানপুরে।

এই ঘটনার বিষয়ে সিআইএসএফ-এর মন্তব্য জানতে চেয়েছিল বিবিসি। কিন্তু সিআইএসএফ-এর জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে এই বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে পারে না।

সিআইএসএফ যা বলছে

ডিপার্টমেন্টের তরফে জানানো হয়েছে, ‘ছুটিতে থাকাকালীন যদি কোনো জওয়ান এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাহলে আমরা সে বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করি না’। তবে সিআইএসএফ-এর রুল বুকে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি তাদের কোনো জওয়ানকে ফৌজদারি মামলায় ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটক করা হয়, তবে তাকে সাসপেন্ড করা হবে।

এই মামলার বর্তমানে আদালত ও পুলিশের তদন্তনাধীন অবস্থায় রয়েছে।

অন্যদিকে, সাহিলের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তাদের এখন একটাই দাবি–– অভিযুক্তের যেন কঠোর শাস্তি হয়। সাহিলের মা বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। যেভাবেই হোক আমরা ন্যায়বিচার চাই। কোনো পিঁপড়ে বা প্রাণীকে হত্যা করা হয়নি। আমরা শুধু আমাদের সন্তানের জন্য ন্যায়বিচার চাই…ব্যাস’। বিবিসি বাংলা

 

এমএইচআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর