দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে একটি নতুন আঞ্চলিক জোট গঠনের চেষ্টা করছে পাকিস্তান। দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার সম্প্রতি বলেছেন, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা করেছে ইসলামাবাদ। ত্রিপক্ষীয় এই উদ্যোগকে সম্প্রসারিত করার জন্য অন্যান্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরেও কোনো দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা সে বিষয়েও কাজ করছে।
কিন্তু ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সংকট ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা বিবেচনা করে, কোনও দেশই নয়াদিল্লিকে বাদ দিয়ে এমন একটি জোটে যোগদানের ঝুঁকি নেবে না বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তানের প্রস্তাব
গত সপ্তাহে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকার দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) প্রতিস্থাপনের জন্য একটি নতুন আঞ্চলিক জোট গঠনের পক্ষে জোর দিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যেই, বিশেষ করে গত মে মাসে দুই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের মধ্যে চার দিনের সামরিক সংঘাতের পর তার এই মন্তব্য এসেছে।
ইসহাক দার দাবি করেন, দক্ষিণ এশিয়া আর ‘শূন্য-সমষ্টির মানসিকতা, রাজনৈতিক খণ্ডিতকরণ এবং অকার্যকর আঞ্চলিক স্থাপত্যের’ মধ্যে আটকে থাকার সামর্থ্য রাখে না, যার কারণ ইসলামাবাদ ‘উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক আঞ্চলিকতা’ চাইছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি ইঙ্গিত দেন, সার্কের বাইরে উদীয়মান বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন রয়েছে। তবে ইসলামাবাদ এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার কল্পনা করে, যেখানে সহযোগিতা বিভাজনের পরিবর্তে সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি অর্জন, আন্তর্জাতিক বৈধতা অনুসারে চলমান বিরোধগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং যেখানে মর্যাদা ও সম্মানের সাথে শান্তি বজায় রাখা হবে।
এরআগে চলতি বছর পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং চীন অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করে। গত জুন মাসে চীনের কুনমিংয়ে তিন দেশ একটি বৈঠক করে, যা এই ধরণের প্রথম বৈঠক ছিল।
আমি আগেই বলেছি, অর্থনীতি থেকে আঞ্চলিক অগ্রাধিকার পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তনশীল জ্যামিতির গোষ্ঠীগুলি কারও অনড়তার কাছে জিম্মি থাকতে পারে না এবং করা উচিত নয়," দার, যিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও, ভারতের প্রতি গোপন ইঙ্গিত করে বলেন।
দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা কেন গুরুত্বপূর্ণ
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, সার্ক দেশগুলোর জনসংখ্যা দুই বিলিয়নেরও বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। তবে বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পারিক বাণিজ্য মাত্র ২৩ বিলিয়ন ডলারে রয়ে গেছে, যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ।
আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাবকে এই অঞ্চলের দুর্বল বাণিজ্য সংযোগের একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো যদি বাধা কমিয়ে আনে তবে তারা ৬৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বিনিময় করতে পারবে, যা তাদের বর্তমান বাণিজ্যের তিনগুণ।
পাকিস্তানের পরিকল্পনা কি কাজে আসবে?
পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ রাবিয়া আখতারের মতে, এই পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রস্তাব সম্ভবত ‘কার্যক্ষমতার চেয়ে বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী’। কিন্তু এটি আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় এবং পুনর্কল্পিত করার পাকিস্তানের ইচ্ছার ইঙ্গিত দেয়।
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ ( সিএসএসপিআর)-এর পরিচালক আখতার আল জাজিরাকে বলেন, প্রস্তাবটির কার্যকারিতা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত, জোটে অংশগ্রহণকারী সম্ভাব্য রাষ্ট্রগুলোর ছোট ছোট ইস্যু কার্যকরী মূল্যায়ন পায় কিনা; এবং দ্বিতীয়ত, জোটটি ভারতের তুলনায় রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে কিনা।’
এদিকে নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক স্বরণ সিং উল্লেখ করেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান অপ্রতিরোধ্য।
সাউথ চায়না গ্লোবাল পোস্টের সাথে আলাপকালে তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের জনসংখ্যা পাকিস্তানের তুলনায় সাত গুণ, এর প্রতিরক্ষা বাজেট ইসলামাবাদের চেয়ে পাঁচ গুণ এবং এর অর্থনীতি ১২ গুণ বড়। এর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও পাকিস্তানের তুলনায় ৪৫ গুণ। এটি আমাদের দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা উদ্যোগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা দেবে, যা ভারতকে তার গঠন থেকে দূরে রাখতে চায়।’
জেএনইউ-এর আরেক সহযোগী অধ্যাপক শান্তেশ কুমার সিং উল্লেখ করেছেন, নেপাল এবং ভুটানের মতো এই অঞ্চলের কিছু ছোট দেশ তাদের রফতানি চাহিদা পূরণের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করে এবং সংকটের সময়ে, যেমন কোভিড-১৯ মহামারীর সময় যেকোনো দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া এবং ভ্যাকসিন কূটনীতির সময়, নয়াদিল্লি নিজেকে একটি অপরিহার্য নেতা হিসেবে প্রমাণ করেছে।
তিনি বলেন, ‘ভারতকে অবশ্যই একজন দায়িত্বশীল এবং সহযোগী নেতা হিসেবে কাজ করে যেতে হবে, আস্থা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ চীনের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত পদক্ষেপের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দিল্লির সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য ‘
সূত্র: এনডিটিভি
এমএইচআর

