১৯৭১ সালের এর যুদ্ধের বিজয় দিবসে ভারতীয় সেনাবাহিনী যে অনুষ্ঠান করে, তাতে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যাবেন আসবে ২০ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল। ওই দলে আটজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দুজন সামরিক অফিসার থাকবেন বলে জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের সূত্রগুলো। এই ১০ জনের সঙ্গেই থাকবেন তাদের পরিবারের একজন করে সদস্য।
এই তথ্য নিশ্চিত করেছে কলকাতায় বাংলাদেশের উপদূতাবাসের সূত্রগুলোও।
বিজ্ঞাপন
প্রতি বছরই ১৬ ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং সামরিক বাহিনীর অফিসারেরা। গত বছর, ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল।
কলকাতায় বিজয় দিবসে কী হয়?
ভারতের সামরিক বাহিনীগুলো ১৯৭১ সালের যুদ্ধ জয়ের দিনটিকে স্মরণ করে প্রতিবছরই বিজয় দিবস পালন করে। রাজধানী দিল্লিসহ সারা দেশেই নানা অনুষ্ঠান হয় সেদিন। তবে বেশি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের সদর দফতর – কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে, যেটির নতুন নাম বিজয় দুর্গ।
বিজ্ঞাপন
এই অনুষ্ঠানমালার মধ্যে থাকে মিলিটারি ট্যাটু – যেখানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা নানা কসরৎ প্রদর্শন করেন। বাহিনীগুলোর ঘোড়া, কুকুর এবং রোবটগুলোকেও হাজির করানো হয় নানা কসরৎ দেখানোর জন্য। থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
মঙ্গল পান্ডে মিলিটারি ট্রেনিং এরিয়ায় এবছরের মিলিটারি ট্যাটু অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।

মূল অনুষ্ঠানটি হয় ফোর্ট উইলিয়াম বা বিজয় দুর্গের পাশে অবস্থিত ‘বিজয় স্মারক’-এ। ১৯৭১-এর যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মরণে সেখানে একটি স্মারক আছে। ওই স্মৃতিস্তম্ভে ১৬ই ডিসেম্বর সকালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর শীর্ষ অফিসারেরা। হাজির থাকেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও যুদ্ধে অংশ নেওয়া অবসরপ্রাপ্ত অফিসারেরা।
প্রতি বছরের মতো এবছরও সব অনুষ্ঠানেই হাজির থাকার কথা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাসহ ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দলটির।
ভারত কেন বিজয় দিবস পালন করে?
বাংলাদেশের মানুষদের একাংশ প্রতিবছরই প্রশ্ন তোলেন যে সে দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস কেন ভারতীয় সেনাবাহিনী পালন করবে?
ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা একাধিকবার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস হলেও একই সঙ্গে সেটি ভারতীয় বাহিনীরও বিজয় দিবস।
তাদের ব্যাখ্যা, ১৯৭১-এর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী যেমন যুদ্ধ করেছিল, তেমনই সরাসরি ভারতীয় বাহিনীগুলোও যুদ্ধ করেছিল তেসরা ডিসেম্বর থেকে। আবার ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীগুলোকে শুধু পূর্ব রণাঙ্গনে নয়, পশ্চিম রণাঙ্গনেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল।

ওই যুদ্ধে মেজর হিসেবে অংশ নেওয়া ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শংকর রায় চৌধুরি বিবিসি বাংলাকে কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য যেটি মুক্তিযুদ্ধ, সেটি ভারতের কাছে ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধের একটি অংশ।
তার কথায়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত হতে সহায়তা করা। এখানে দুটি দিকই আছে। কারণ আরও দুটি ফ্রন্টে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ চলছিল। পূর্ব পাকিস্তানেও পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করা ছিল ওই যুদ্ধেরই একটি অংশ। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো ভারতীয় বাহিনী।’
ভারত সরকার ২০০১ সালে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিল যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতীয় সামরিক বাহিনীগুলোর ৩ হাজার ৮৪৩ জন সদস্য নিহত এবং ৯ হাজার ৮৫১ জন সদস্য আহত হয়েছিলেন। নিজেদের বাহিনীর এই শহীদদেরও ভারতীয় সামরিক বাহিনী স্মরণ করে ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে।
যেভাবে ভারত জড়িয়েছিল ৭১-এর যুদ্ধে
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালানোর পর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের। তবে ডিসেম্বর মাসে সরাসরি ভারত যুদ্ধে জড়ায়।
তার আগে কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে অবস্থান নেয়। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার কলকাতার যে ভবন থেকে পরিচালিত হতো, তাদের সঙ্গেও সর্বক্ষণ যোগাযোগ রেখে চলত ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ড, যার সদর দফতর এই ফোর্ট উইলিয়ামেই।
এছাড়া মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ভারতের মাটিতেই প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং ভারত তাদের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। তবে ৩ ডিসেম্বর ভারত সরাসরি যুদ্ধে নামার আগে থেকেই পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছিল। পাকিস্তানও সামরিক বাহিনী জড়ো করছিল তাদের সীমান্তে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বোঝানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে জুন মাস থেকে বিভিন্ন দেশে সফর শুরু করেন।
পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে এবং এর ফলে ভারত কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে বিষয়টি বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানের কাছে তুলে ধরেন তিনি।
প্রকৃতপক্ষে, সেসব সফরের মধ্য দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের ভিত্তি তৈরি করেন। বিবিসি বাংলা
এমএইচআর

