ইসরায়েল সমর্থিত ফিলিস্তিনের গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘পপুলার ফোর্সেস’ নেতা ইয়াসের আবু শাবাব নিহত হয়েছেন। পপুলার ফোর্সেস এবং ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই খবরের মধ্য দিয়ে এমন এক ব্যক্তির চূড়ান্ত পরিণতি হলো, যিনি ইসরায়েলের সমর্থক হিসেবে এবং গাজায় হামাসের বিকল্প হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। যদিও ফিলিস্তিনিরা তাকে ইসরায়েলের সহযোগী হিসেবে উপহাস করতো।
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ গাজার বেদুঈন তারাবিন উপজাতি নেতা আবু শাবাবের বয়স যখন ৩০ বছরের কাছাকাছি, তখনও তাকে কেউ চিনতো না। কিন্তু গত বছরই গাজা উপত্যকায় তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। এরপর থেকেই ফিলিস্তিনিরা তাকে চিনতে শুরু করে।
প্রথমদিকে তার মিলিশিয়া দলটি ‘অ্যান্টি-টেরর সার্ভিস’ হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু চলতি বছরের মে মাসে গোষ্ঠীটি পপুলার ফোর্সেস হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। এটি অন্তত ১০০ যোদ্ধার অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত একটি দল ছিল। দলটি ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত গাজায় কর্মকাণ্ড চালাতো।
গোষ্ঠীটি একটি অপরাধী চক্র এবং ইসরায়েলি প্রক্সি ফোর্স হয়ে কাজ করতো। কিন্তু তারা নিজেদেরকে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা জাতীয়তাবাদী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করতো। আর এই ব্র্যান্ডিং ইসরায়েলের স্বার্থই রক্ষা করতো। এমনকি গোষ্ঠীটির চূড়ান্ত লক্ষ্য কি তা কখনও স্পষ্ট ছিল না। বিশেষ করে যখন এটা প্রমাণিত হয়, গোষ্ঠীটির ওই অর্থে কোনো জনসমর্থন নেই।
আর এই কারণেই অনেক ফিলিস্তিনির কাছে আবু শাবাব একজন অপরাধী। এর আগে মাদক সংক্রান্ত অভিযোগে গাজার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে পাঠিয়েছিল। কিন্তু গাজা যুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি জেল থেকে পালিয়ে যান।
বিজ্ঞাপন
গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়ে ৭০ হাজার ১২০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। সেই ইসরায়েলের সঙ্গে মিত্রতার কারণে অধিকাংশ ফিলিস্তিনির কাছে তাকে অগ্রহণযোগ্য করে তুলে। এমনকি তার নিজের গোত্রেও তিনি হয়ে ওঠেন অপরাধী। তার গোত্র এক বিবৃতিতে বলেছে, আবু শাবাবের হত্যাকাণ্ড একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সমাপ্তি হিসেবে কাজ করছে, তিনি উপজাতিদের ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করেননি।
আবু শাবাবের আদর্শ কি ছিল তা নির্ধারণ করা খুব কঠিন। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, তিনি আসলে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানের চেয়ে, ক্ষমতার প্রভাব দ্বারা চলতেন।
প্রাথমিকভাবে আবু শাবাবের গোষ্ঠীর ব্র্যান্ডিংয়ে ‘সন্ত্রাস-বিরোধী’ অভিধা ব্যবহার করা হয়েছিল। যদিও বিষয়টি হাস্যকর ছিল। কারণ, তার গোষ্ঠীর সঙ্গে আইএসআইএল (আইএসআইএস) এর সংযোগের তথ্য ছিল। যদিও সেই সংযোগ অভিন্ন মতাদর্শের চেয়ে মিসরীয় সিনাই উপদ্বীপ থেকে গাজায় চোরাচালানে সহযোগিতা সম্পর্কিত ছিল।
আবু শাবাবের পেছনের গল্প আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার উপস্থিতির মধ্যে বেশ অমিল ছিল। তিনি ইংরেজিতে পোস্ট করতেন, এমনকি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে তার নামে একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছিল।
ওই নিবন্ধে আবু শাবাব দাবি করেন, দক্ষিণ গাজার পূর্ব রাফাহ’র বিশাল অংশ তার পপুলার ফোর্সেস নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেখানে নতুন ভবিষ্যত নির্মাণে তারা প্রস্তুত।
তার নামে লেখা ওই নিবন্ধে বলা হয়, যুদ্ধের ডামাডোলে হামাসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন ফিলিস্তিনিদের আলাদা করাই তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
আবু শাবাব ইসরায়েলের সঙ্গে থাকা সম্পর্ক আড়াল করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জুন মাসে স্বীকার করেন, তার সরকার হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে ব্যবহার করছে। আর সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়েছিল, হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা সেই গোষ্ঠী ছিল আবু শাবাবের বাহিনী।
নেতানিয়াহুর মতে, নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পরামর্শেই তিনি এই ধরনের বাহিনী ব্যবহারের ধারণা পান। এমনকি অতীতে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী সাউথ লেবানন আর্মির মতো স্থানীয় গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কাজ করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও, তিনি এই চেষ্টা চালান।
এদিকে, পপুলার ফোর্সেস নিজেদের গাজায় অতি প্রয়োজনীয় ত্রাণ বিতরণের সাহায্যকারী হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল সমর্থিত জিএইচএফ দ্বারা পরিচালিত এলাকাগুলোতে।
আবু শাবাব সিএনএনকে বলেছিলেন, তার সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত যে দলটির নেতৃত্ব তিনি দিয়েছেন, তারা লুটপাট এবং দুর্নীতির হাত থেকে মানবিক সাহায্য রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি তার দলের সাহায্য বিতরণের ছবিও শেয়ার করেছিলেন।
যদিও এরপর থেকে আবু শাবাব এবং তার দল পপুলার ফোর্সেসের বিরুদ্ধে ত্রাণবহর থেকে ত্রাণ লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। ওয়াশিংটন পোস্ট জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ এক স্মারকলিপির বরাতে তাকে ‘পরিকল্পিত এবং ব্যাপক লুটপাটের পেছনের প্রধান এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী লোক’ হিসেবে অভিহিত করে। আর গাজার নিরাপত্তা সূত্রগুলি আল জাজিরাকে নিশ্চিত করেছে, ইসরায়েল সমর্থিত এ গোষ্ঠীটি লুটপাটে অংশ নিয়েছিল।
ত্রাণ প্রবেশাধিকারের ওপর ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞা এবং ফিলিস্তিনি অবকাঠামো ধ্বংসের ফলে গাজা যখন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। আর ঠিক সেই সময় ত্রাণ লুটপাটের এই অভিযোগগুলো আবু শাবাব যে কেবল একজন ইসরায়েলি প্রক্সি সেই ধারণাকে আরও প্রবল করে।
তাই খুব কম ফিলিস্তিনি, এমনকি যারা হামাস বিরোধী ছিলেন, তারাও হয়তো আবু শাবাবের নিহত হওয়ার পর চোখের জল ফেলেননি। আবু শাবাব কীভাবে খুন হলেন তা এখনও অস্পষ্ট। ঠিক যেমন অস্পষ্ট তার অতীত এবং যুদ্ধের সময় তার ভূমিকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা স্পষ্ট হলো যে, হামাসের প্রকৃত বিকল্প হওয়ার মতো সমর্থন বা ক্ষমতা তার ছিল না। আর তাই তিনি ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছিলেন।
এফএ

