ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম ভারত সফরে আসছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আগামী বৃহস্পতিবারই তার দুই দিনের নয়াদিল্লি সফর শুরু হওয়ার কথা। সফরে পুতিন ভারতের কাছে রুশ তেল, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। তবে রুশ প্রেসিডেন্টের এই সফর ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ঐতিহাসিক। সোভিয়েত আমল থেকেই ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সখ্য। ভারতের পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনায় রাশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এছাড়াও ভারতের সামরিক সরঞ্জাম এক সময় প্রায় পুরোটাই রাশিয়া থেকে আসতো।
বিজ্ঞাপন
সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
স্নায়ু যুদ্ধের শেষ হয়েছে সোভিয়েতের পতনের মাধ্যমে। কিন্তু ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের বদল হয়নি। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার দূরত্ব তৈরি হয়নি। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে ভারত ভোটাভুটিতে অংশ না নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে চায় না। বিপরীতে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত সস্তায় অপরিশোধিত তেল কিনেছে। এর জেরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের শাস্তি হিসেবে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করেছিলেন। তার পরেও দুই দেশের সম্পর্কের চরিত্র বদলায়নি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর সেই সম্পর্কের বিষয়টিই আরও একবার প্রমাণ করে দিচ্ছে।
ভারতের সেনা বাহিনীর সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘পুতিনের ভারত সফর অনেকগুলি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।’
তার মতে, পুতিনের ভারত সফর দুইটি দিক থেকে থেকে বোঝা দরকার। এক, এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এবং দুই এর বাণিজ্যিক তাৎপর্য। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্র ছিল সামরিক। দুই তেল।
বিজ্ঞাপন
সামরিক সম্পর্ক
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপরি) তথ্য অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে রাশিয়ার থেকে ভারত ৭০ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম কিনেছিল। ২০০২ সালে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরঞ্জাম নেওয়া হয়েছিল- ৮৯ শতাংশ। ২০১২ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৮৭ শতাংশ।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার বাজারের বিকেন্দ্রিকরণ হয়। ইউরোপ, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং অ্যামেরিকার সঙ্গে একের পর এক সামরিক চুক্তি হয় ভারতের। পাশাপাশি ভারত নিজস্ব প্রযুক্তিতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ফলে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির আদানপ্রদানে গুরুত্ব দেয় ভারত।
২০১৪ সালে রাশিয়ার থেকে ভারত সামরিক সরঞ্জাম কেনে ৪৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে সংখ্যাটি আরও কমে ৩৬ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।
আপাতভাবে মনে হতেই পারে সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে রাশিয়ার তাৎপর্য কমেছে। কিন্তু সামরিক বিশষজ্ঞেরা বিষয়টিকে সেভাবে দেখেন না।
মূলত, রাশিয়ার থেকে ভারত মূলত অর্থোডক্স যুদ্ধের সরঞ্জাম কেনে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ সরঞ্জাম কেনার পরিমাণ কমলেও ভারত এখনো রাশিয়ার থেকে সামরিক ক্ষেত্রের বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো কেনে। যেমন এস ৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। অপারেশন সিঁদুরে যে ডিফেন্স সিস্টেম একের পর এক পাকিস্তানের ড্রোন এবং মিসাইল আক্রমণ প্রতিহত করেছে।
এছাড়াও আধুনিক নেক্সট জেনারেশন মিসাইল, পারমাণবিক চুল্লি, পরমাণু অস্ত্র বহনকারী সাবমেরিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম ভারত এখনো রাশিয়ার থেকে নেয়।
সিপরির তথ্য বলছে, ভারত রাশিয়ার থেকে সব চেয়ে বেশি যুদ্ধবিমান, সাঁজোয়া গাড়ি, মিসাইল, যুদ্ধজাহাজ, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, নানা ধরনের ইঞ্জিন এবং নৌবহরের অস্ত্র কিনেছে।
যৌথ উৎপাদনে গুরুত্ব
পুতিনের এবারের সফরে দুই দেশের মধ্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চুক্তি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যেখানে এস ৫০০ এর মতো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেতে পারে ভারত। পাশাপাশি মিসাইল, নৌবহরের অস্ত্রের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ চুক্তি হতে পারে।
তবে ভারত চাইবে, আর বেশি যৌথ উৎপাদনের রাস্তায় হাঁটতে। যেখানে প্রযুক্তি ভাগ করবে রাশিয়া। বস্তুত, ভারত ও রাশিয়ার সামগ্রিক সামরিক বাণিজ্য আবার বাড়তে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
রাশিয়ার তেল
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার তেল এবং গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সে সময় অনেক কম বিনিময় মূল্যে রাশিয়া ভারতকে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করেছে। পশ্চিমা দেশগুলির চোখ রাঙানি সত্ত্বেও ভারত সেই তেল কিনেছে। ট্রাম্প শুল্ক ধার্য করার পরেও রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করেনি ভারত। খেয়াল রাখতে হবে, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারী রাষ্ট্র হলো ভারত। ফলে ভারতকে সকলেই তেল বিক্রি করতে চায়। রাশিয়া ভারতের এই বাজারটি ধরে রেখেছে। যদিও তেল ছাড়াও পরমাণু চুল্লি, রাসয়নিক, সারের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস রাশিয়া ভারতকে বিক্রি করে।
ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, রাশিয়ার থেকে ভারত জিনিস আমদানি করে ৬ দমশিক ৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত। ২০২০-২১ সালে এক দশমিক চার শতাংশ থেকে সংখ্যাটি লাফিয়ে পৌঁছেছিল ৬ দশমিক ৫। ২০২৪-২৫ সালে যা ৯ শতাংশে পৌঁছায়। চলতি বছরে এখনো পর্যন্ত সংখ্যাটি ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এই বিরাট লাফের অন্যতম কারণ হলো তেল আমদানি।
উল্টো দিকে ভারত রাশিয়ায় জিনিস রফতানি করে এক শতাংশ। গত পাঁচ বছরের হিসেব ধরলে সংখ্যাটি ০ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ১ শতাংশ। ভারত রাশিয়ায় রফতানির পরিমাণ বাড়াতে চায়। পুতিন এলে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হবে।
অর্থনীতিবিদ এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলকাতার অধ্যাপক শুভনীল চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘রাশিয়াকে আমরা খুব বেশি রপ্তানি করি না। মোট রপ্তানির পরিমাণ চার থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। আর আমদানি করা হয় ৬০-৬৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে একটা ট্রেড ডেফিসিট বা বাণিজ্য ঘাটতি আছে। সেখানে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ সব সময়েই আছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা রাশিয়াতে যা রফতানি করি তা মূলত লো-লেভেল পণ্য। যেমন কৃষিজাত দ্রব্য, ওষুধ তৈরির কাঁচামাল। ভারতের প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য রত্ন ও গয়না এবং বস্ত্র। কিন্তু এর কোনো কিছুই রাশিয়ায় তেমন যায় না। পুতিন যখন আসছেন, তখন সেই সব পণ্য রাশিয়ায় আমদানি করা যায় কিনা সে বিষয় কথা বলার ভালো সুযোগ আছে।’
শুভনীল বলেন, ‘ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে এই পণ্যগুলি বিপদে পড়েছে। ভারতের এখন রপ্তানি বহুমুখী করা প্রয়োজন। রত্ন ও গয়নার শিল্প বা টেক্সটাইল শিল্পের স্টেকহোল্ডাররা চেষ্টা করছেন। কিন্তু রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু বেসরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট হয় না। সরকারি উদ্যোগ লাগে। এক্ষেত্রে এটা মোক্ষম সময়।’
ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া বিরোধী ভূরাজনৈতিক জোট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে গ্লোবাল সাউথেরও একটি মুখ তৈরি হয়েছে। ব্রিকস যেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পুতিনের এই ভারত সফর সে দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
পুতিনকে আহ্বান জানিয়ে ভারত আবার বুঝিয়ে দিল গ্লোবাল সাউথের মঞ্চে ভারত রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবেই মনে করে। পশ্চিমা বিশ্ব এই বার্তাকে কীভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
এমএইচআর

