বর্তমান সময়ে ভূরাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় রাশিয়া ও ইউক্রেন সংকট। প্রতিবেশি এই দুই দেশের রয়েছে হাজার বছরের সম্মিলিত ইতিহাস। তাদের দীর্ঘ দিনের বিবাদের ইতিহাস বর্তমান সময়ের সংঘাতময় পরিস্থিতির মঞ্চ তৈরি করার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী।
ইউক্রেনের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে বিশ শতকে। ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর নৃশংস গৃহযুদ্ধের কবলে পড়তে হয় ইউক্রেনকে। ১৯২২ সালে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩০ সালের প্রথমদিকে দেশটির কৃষকদের জোরপূর্বক ‘কালেক্টিভ ফার্ম’ বা সামষ্টিক খামার ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয়। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিনের অদূরদর্শী সংস্কার পরিকল্পনার কারণে দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। প্রাণ হারান কয়েক লাখ ইউক্রেনবাসী।
দেশ দু’টির জাতিগত উৎপত্তি
রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশই জাতিগতভাবে স্লাভিক। আজ থেকে হাজার বছর আগে গঠিত হয়েছিলো প্রথম স্লাভিক রাজ্য ‘কিয়েভান রুশ’। সেই স্লাভিক রাজ্যর কেন্দ্রবিন্দু ছিলো বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। এই রাজ্য থেকেই জন্ম লাভ করেছে বর্তমান রাশিয়া ও ইউক্রেন।
৯৮৮ সালে নভগোরদ-এর প্যাগান প্রিন্স ভ্লাদিমির ১ অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান ধর্ম গ্রহণ করেন। তারপর থেকেই অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান সেখানকার রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয়। তিনি ছিলেন কিয়েভের গ্যান্ড প্রিন্স। ক্রাইমিয়ার শহর চেরসোনেসাস-এ তিনি ব্যাপ্টাইজড হন। ইতিহাসের এই অংশটুকুর উল্লেখ করে রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, রুশ ও ইউক্রেনিয়ানরা মূলত একই জাতি। তাদের অতীত ইতিহাসই দেশ দু’টির অভিন্ন জাতিসত্তার ইঙ্গিত বহন করে।
ইউক্রেনে রুশিফিকেশনের শুরু যেভাবে
বিজ্ঞাপন
বিগত ১ হাজার বছর ধরেই বারবার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়ে আসছে ইউক্রেন। তেরো শতকে মঙ্গল যোদ্ধারা কিয়েভান রুশ দখল করে নিয়েছিলো। ষোল শতকে পোলিশ ও লিথুয়ানিয়ান সেনারা আক্রমণ চালিয়েছিলো ইউক্রেনে। সতেরো শতকে পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ-এর সঙ্গে রাশিয়ার জারদের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের পরিণাম হিসেবে খণ্ডিত হয় ইউক্রেন। ইউক্রেনের দীর্ঘতম নদী নাইপারের পূর্ব দিকের নিয়ন্ত্রণ নেয় রাশিয়া যেটির নামকরণ হয় ‘লেফ্ট ব্যাংক’। নাইপার নদীর পশ্চিম দিকের ভূমি যা ‘রাইট ব্যাংক’ নামকরণ করা হয় তা পোল্যান্ডের অধীনে চলে যায়।
এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৭৯৩ সালে ‘রাইট ব্যাংক’ তথা নাইপার নদীর পশ্চিম তীর দখল করে নেয় রাশিয়া। এর পরের বছর গুলোতে ইউক্রেনের নিজস্ব ভাষা ও এর প্রয়োগের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দেয় রাশিয়া। ইউক্রেনের জনগণের ওপর রুশ অর্থোডক্স বিশ্বাস জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। ইতিহাসের পাতায় এটি ‘রুশিফিকেশন’ নামে পরিচিত।
ইউক্রেনের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত
তবে ইউক্রেনের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে বিশ শতকে। ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর নৃশংস গৃহযুদ্ধের কবলে পড়তে হয় ইউক্রেনকে। ১৯২২ সালে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩০ সালের প্রথমদিকে দেশটির কৃষকদের জোরপূর্বক ‘কালেক্টিভ ফার্ম’ বা সামষ্টিক খামার ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয়। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিনের অদূরদর্শী সংস্কার পরিকল্পনার কারণে দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। প্রাণ হারান কয়েক লাখ ইউক্রেনবাসী। এতে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যা বহুলাংশে কমে যায়। স্টালিন পূর্ব ইউক্রেনে বৃহৎ সংখ্যক রুশ ও অন্যান্য সোভিয়েত নাগরিকদের পূর্ব ইউক্রেনে বসবাসের জন্য প্রেরণ করেন। যদিও তাদের বেশির ভাগই ইউক্রেনের ভাষায় কথা বলতে পারত না। নেই ইউক্রেনের সঙ্গে কোনো ধরনের ঐতিহ্যগত সাদৃশ্যও।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই পূর্ব ইউক্রেন রাশিয়ার অধীনে এসেছে পশ্চিম ইউক্রেনের অনেক আগে। তাই পূর্ব ইউক্রেনের নাগরিকদের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি রয়েছে স্বাভাবিক সমর্থন। অন্যদিকে পশ্চিম ইউক্রেন বহু শতক ধরে পোল্যান্ড ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিলো। তাই তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে পশ্চিমাপন্থী মনোভাব। পূর্বাঞ্চলীয়দের বেশির ভাগের ভাষাই রুশ এবং ধর্মের দিক দিয়ে তারা অর্থোডক্স। অন্যদিকে পশ্চিম ইউক্রেনবাসীর ভাষা ইউক্রেনিয়ান এবং তারা ক্যাথোলিক ধর্মমতে বিশ্বাসী।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও চলমান ইউক্রেন সংকট
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে ইউক্রেন অবশেষে ফিরে পায় তার বহুল কাঙ্খিত স্বাধীনতা। কিন্তু দেশটিকে একক জাতিসত্তার ভিত্তিতে একত্রিত করা এতটা সহজ ছিলো না। সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়াটা ছিলো একটি কষ্টসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া। তবে ইউক্রেনবাসী যে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এখনো এক হতে পারেনি সাম্প্রতিক সংঘাত তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বহু ইউক্রেনবাসী বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয়দের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি দুর্বলতা প্রবল।
২০০৪ সালের ‘অরেঞ্জ বিপ্লব’এর মধ্য দিয়ে হাজারো ইউক্রেনবাসী ইউরোপের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ২০২১ সালের আজকের দিনটিতে এসেও ইউক্রেনের ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নতুন উত্তেজনা। ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলের লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া এবং সেখানে সেনা পাঠিয়েছে শান্তি রক্ষা মিশনের নামে।
যুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। তাই রুশ-ইউক্রেন ইস্যুর কুটনৈতিক সমাধানই কামনা করে বিশ্বের লক্ষ কোটি শান্তিপ্রিয় মানুষ।
তথ্যঋণ: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
এমএসএ

