ভারতে বাংলাভাষী মুসলিম হলেই তাকে বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে পুশব্যাক করার অপচেষ্টা চলছে বহুদিন ধরেই। সম্প্রতি তা কয়েকগুণ বেড়েছে।
আর এসব অনিয়ম বা পুশব্যাকের কাজে জড়িত ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের (বিএসএফ) পোশাকে কোন নাম লেখা নেই।
বিজ্ঞাপন
জওয়ান হোক বা কর্মকর্তা, কারও নাম জানার উপায় নেই। জংলাছাপ উর্দির ডান দিকের বুকপকেটের ঢাকনির মাথায় থাকার কথা বিএসএফ জওয়ানের। কিন্তু একজনের উর্দিতেও তা নেই। মুখচোখ থমথমে।
চেকপোস্ট পেরিয়ে স্থানীয় যানবাহন এবং বাসিন্দাদের যাতায়াত সামলাচ্ছেন কয়েকজন। কয়েকজন টিনের ছাউনির পিছন দিকে জড়ো হয়ে থাকা জটলার সামনে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ এবং লেখালিখি করছেন। বাকি দু’চারজন সতর্ক নজর রাখছেন চেকপোস্টের সামনে ঘনিয়ে ওঠা অভূতপূর্ব পরিস্থিতির দিকে।
কিন্তু কারও বুকে নাম লেখা নেই। নাম লেখা হচ্ছে শুধু 'অনুপ্রবেশকারী'দের। যারা ভিড় জমিয়েছেন সীমান্তে। টিনের ছাউনির পিছনে।
আরও পড়ুন:
ঘটনাস্থল পশ্চিমবঙ্গের হাকিমপুর। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের আগে অন্তিম চেকপোস্ট। এ পারে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার স্বরূপনগর থানা এলাকা। ওপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলা।
পরিস্থিতি সত্যিই অভূতপূর্ব। গরু পাচার, সোনা পাচার, মাদক চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাকারবারী- নানা কারণে বারবার খবরে আসে স্বরূপনগর। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার সব রকম লক্ষণ বছরভর ফুটে থাকে ইছামতি আর সোনাইয়ের ঘেরাটোপে বন্দি আদ্যোপান্ত গ্রামীণ জনপদটিতে।
কিন্তু যে উপসর্গ গত ১৫ দিন ধরে প্রধান হয়ে উঠেছে, তা স্বরূপনগর আগে কখনও দেখেনি। এই এলাকা ১৯৭১ সালের শরণার্থী স্রোত দেখেছে। শরণার্থীদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান সুনিশ্চিতকরণের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ দেখেছে। উদ্বাস্তুসেবার কাজে জুড়ে থাকার নামে হাতসাফাই করে সুযোগসন্ধানীদের ফুলেফেঁপে উঠতে দেখেছে।
কালক্রমে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে উঠতে দেখেছে। চোরাচালান সাম্রাজ্যে একের পর এক মহীরুহের উত্থান-পতন দেখেছে। এলাকার জনবিন্যাস ধীরে ধীরে বদলাতে দেখেছে। যা দেখেনি, তা হল পশ্চিমবঙ্গ থেকে মানুষের এই উল্টো স্রোত। ধরে ধরে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য জরো করা হচ্ছে মুসলিমদের।
দিল্লিসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে ধরপাকড় শুরুর পরেই এই স্রোত টের পেতে শুরু করেছিল হাকিমপুর। গত ১৫ দিন ধরে তা বেড়েছে। শেষ সাত দিনে হাকিমপুর চেকপোস্টের সামনে আক্ষরিক অর্থেই ঢল নেমেছে।
হাকিমপুর চেকপোস্টের ভিতরে ডাকা হয়েছে ধরে আনা লোকজনকে। বাংলাদেশে পাঠানোর আগে নাম-ঠিকানা নথিবদ্ধ করা হচ্ছে।
১০০ মিটার অন্তর একটা করে অস্থায়ী এবং অপরিসর ছাউনি। কোথাও ১০০ জন অপেক্ষায়। কোথাও ১৫০ জন, কোথাও ২০০ জন। আচমকা গুটিয়ে নেওয়া সংসার একাধিক বিশালকায় ব্যাগে ভরে রাতারাতি তারা হাজির সীমান্ত চেকপোস্টে।
কেউ দু’দিন অপেক্ষায়, কেউ তিন দিন। ভারতের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া পিচরাস্তার ধারে ত্রিপল বা পলিথিন বিছিয়ে দিনরাত কাটছে।
সাতক্ষীরায় ফেরৎ পাঠানো হচ্ছে জাকিরুল, সুফিয়ার অনেককে। কোলে দু’মাসের সন্তান নিয়ে এখন প্রায় খোলা আকাশের নীচে অপেক্ষায় হাবিব। তাও এমন এক এলাকায়, যেখানে সন্ধ্যা নামলেই ঝপ করে নেমে যাচ্ছে পারদ।
ভারতীয় কোনও কার্ড বা পরিচয়পত্র নেই তাদের? অধিকাংশের উত্তর— ‘‘না না, ও সব আমাদের নেই।’’ কেউ দু’দিন ধরে বসে। কেউ তিন দিন। অপেক্ষা সীমান্তের ওপারে যাওয়ার জন্য বিএসএফের ডাক আসার।
কেন হঠাৎ এভাবে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর বিএসএফের কাছেও নেই। চেকপোস্টে কর্তব্যরতদের কেউই আনুষ্ঠানিক ভাবে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন।
স্থানীয় কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও সাংবাদিকদের কোনও লাভ হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, ‘এখানে কারও সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। কেউ সরকারি ভাবে কিছু বলবেন না। যা বলার ডিআইজি সাহেব বলবেন। দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের সদর দফতরে চলে যান।’ অর্থাৎ হাকিমপুর থেকে সোজা নিউটাউন।
আরও পড়ুন:
বারবার নানা ওছিলায় চেকপোস্টের ছাউনিতে ঢুঁ মারার জেরেই হোক বা নাছোড়বান্দার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছায় এক সাব-ইনস্পেক্টর সামান্য মুখ খুললেন পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে। প্রশ্ন ছিল, এই ‘পুশব্যাক’ হচ্ছে কোন আইনের বলে? কেউ যদি ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বীকার করে নেন, তিনি অবৈধ পথে ভারতে ঢুকেছেন, তা হলে তো তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রেফতার করার কথা। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা। তার পরে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে যে, তাদের জেলে ভরা হবে নাকি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
হাকিমপুরে তা তো হচ্ছে না! সাব-ইনস্পেক্টর বললেন, ‘আগে যা হয়েছে, সে সব কথা ছেড়ে দিন। এখনকার মতো পরিস্থিতি কি আগে কখনও দেখেছেন? আমাদের এখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করতে হচ্ছে।’
কীভাবে হচ্ছে সে কাজ? বিএসএফ আধিকারিক জানালেন, যারা চেকপোস্টের সামনে এসে অপেক্ষা করছেন, তাদের মধ্য থেকে রোজ ২০০ জনকে ভাগে ভাগে ডেকে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে তাদের ঠিকানা কী জেনে নেওয়া হচ্ছে। ছবিও তুলে রাখা হচ্ছে। বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ডিং করা হচ্ছে। তার পরে চেকপোস্ট থেকে বিএসএফের গাড়িতে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সীমান্ত লাগোয়া ক্যাম্পে।
তাদের নামঠিকানা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে দেওয়া হচ্ছে। তারা নাম-ঠিকানা যাচাই করে নিশ্চিত হওয়ার পরে তাদের ফেরত নিচ্ছে। কারও নাম-ঠিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি বলে তাকে বিজিবি ফেরত নেয়নি, এমন ঘটনা কি এখনও পর্যন্ত ঘটেছে। সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, ঘটেনি।
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) শুরু হতেই সবাই প্রমাদ গুনেছেন। দলে দলে বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানো হচ্ছে।
এসআইআর নামক পরিভাষাটি অধিকাংশেরই অজানা। কেউ বলছেন, ‘ওই যে, এনআরসি শুরু হয়েছে।’ কেউ বলছেন, ‘এ দেশের সরকার এখন তো আমাদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে বলছে।’
কেউ বলছেন, ‘সত্যি কথায় লজ্জা কী? আমাদের তো এখন তাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই চলে যাচ্ছি।’ দিন যাচ্ছে আর ভিড় জমছে হাকিমপুরে।
-এমএমএস

