মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন কুয়ালালামপুর থেকে এয়ার ফোর্স ওয়ানে চড়ে রওনা দিলেন, তখন তার ২৪ ঘণ্টার ব্যস্ত সফর শেষ হয়েছে। হোয়াইট হাউসের ভাষায় ট্রাম্পের সফর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘শান্তি ও সমৃদ্ধি’ বয়ে এনেছে। এরপর ট্রাম্প উড়ে যান জাপানে, এরপর যাবেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। বৃহস্পতিবার সেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার বহুল প্রত্যাশিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তবে ট্রাম্পের আসিয়ান সম্মেলনে যোগদানই এই আঞ্চলিক জোটকে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় আলোচনায় এনে দিয়েছে।
একসময় জোটটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের সুযোগ। এই দুই প্রতিবেশি দেশের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ জুলাইয়ে অনেকটা (সর্বাত্মক) বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নিয়েছিল। তিনি এই ‘যুদ্ধ মীমাংসা করে নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার অভিযানের’ অংশ হিসেবেই দেখেছেন, যদিও থাই কর্তৃপক্ষ এটিকে ‘শান্তিচুক্তি’ বলতে দ্বিধা করেছে। খবর বিবিসির।
বিজ্ঞাপন
এই সাফল্যের একটি বড় অংশের কৃতিত্ব গেছে আসিয়ানের বর্তমান চেয়ার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের থলিতে; যিনি দুই দেশের মধ্যে প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি আয়োজনে জোরালো ভূমিকা রাখেন।
রাজনীতিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞ আনোয়ার তার থাই ও কম্বোডিয়ান রাজনীতিকদের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েছেন এবং একই সঙ্গে ট্রাম্পকেও আকৃষ্ট করেছেন। এমনকি ‘কারাদণ্ড’ নিয়ে রসিকতাও করে গেছেন, যা ট্রাম্প হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। তবু শেষ পর্যন্ত চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিল মূলত ট্রাম্পের আরোপিত অর্থনৈতিক হুমকির পরই।
রোববারের (২৬ অক্টোবর) চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য চুক্তিও ঘোষণা করা হয়। ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তিনি অর্থনৈতিক চুক্তিকেই শান্তি প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন। বেশিরভাগ আসিয়ান নেতার জন্য ট্রাম্পের উপস্থিতি ছিল এক বিরল সুযোগ। বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি পুনর্গঠনের আলোচনায় সবার চোখ ও কান সেদিকে নিবদ্ধ।
আসিয়ানের অধিকাংশ দেশই রফতানিনির্ভর অর্থনীতি, আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের অন্যতম প্রধান বাজার। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যদিও তারা শুল্কহার কমাতে পারেনি, কিছু পণ্যে ছাড় আদায় করতে সক্ষম হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ পাবলিক পলিসি স্কুলের ডিন জোসেফ লিয়াও বলেন, “ট্রাম্প এখানে মূলত ফটোসেশনের জন্য এসেছিলেন। এটি তার সাফল্যের মুকুটে আরেকটি পালক যোগ করেছে। যেহেতু তিনি এসেছেন, সবাই ভেবেছে- চলো, সুযোগটা কাজে লাগাই।”
১৯৬৭ সালে কমিউনিজমের (সমাজতন্ত্র) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গঠিত আসিয়ান এখন মূলত কূটনৈতিক সংলাপ ও বাণিজ্য আলোচনার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। এর শক্তি হলো; এটি এমন একটি মঞ্চ যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় কাউন্সিল, কানাডা, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় শক্তিগুলো একই সঙ্গে অংশ নিতে পারে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে আসিয়ান গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে; অঞ্চলজুড়ে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও বাজার সমন্বয় করেছে। তবু এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার দাবানল থেকে সৃষ্ট দূষণ বা দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিরোধের মতো ইস্যুতে আসিয়ান খুব কমই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে।
২০২১ সালে শুরু হওয়া মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ বন্ধে ব্যর্থতাকে আসিয়ানের সবচেয়ে বড় পরাজয় হিসেবে দেখা হয়। এই বছরও তারা জান্তা সরকারকে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু চার বছরেও কোনো ইতিবাচক ফল মেলেনি।
জান্তা সরকারের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক আমন্ত্রণের ঘোষণায় আসিয়ান শুধু বলেছে— ‘নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় এবং সহিংসতা বন্ধ করাই এখন প্রধান শর্ত।’ এটিই ছিল আসিয়ানের কূটনৈতিক ভাষায় সর্বোচ্চ কঠোরতা।
আসলে আসিয়ান কোনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক জোট নয় কিংবা ন্যাটো বা জাতিসংঘের মতো সামরিক কাঠামোও নেই। ফলে চাপ প্রয়োগের একমাত্র অস্ত্র কূটনীতি।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মূল দুর্বলতা হলো সদস্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘অহস্তক্ষেপ’ নীতি। সমর্থকরা বলেন, এই নীতিই আসিয়ানের ঐক্য রক্ষা করে; সমালোচকরা বলেন, এটিই একে ‘দাঁতহীন’ করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক হুয়ং লে থু বলেন, ‘“রাজনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে সদস্যরা কখনও সার্বভৌমত্ব ছেড়ে আসিয়ানের বৃহত্তর স্বার্থে একত্র হবে; এটা এক প্রকার অসম্ভব কল্পনা।”
তিনি আরও বলেন, “মানুষ যখন বলে আসিয়ান নিজের ঘর সামলাতে পারে না, তারা পুরোপুরি ঠিক বলে। একতা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যদি বাস্তব সমস্যা সামলানো না যায়, তবে আসিয়ানের প্রাসঙ্গিকতা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
দুর্বলতার মাঝেও বিরল সাফল্য
থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া যুদ্ধ ঠেকাতে না পারা ‘আসিয়ানের ভঙ্গুরতা’র প্রতীক হলেও, এই সংঘাতের অবসান এবং ট্রাম্পের উপস্থিতি এটিকে একটি বিরল সাফল্যে পরিণত করেছে।
যদিও রোববার স্বাক্ষরিত চুক্তি মূল সীমান্ত সমস্যার সমাধান নয়, এটি সহিংসতা থামানো ও সংলাপ শুরু করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপের সূচনা; এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কুয়ালালামপুর সম্মেলনে আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে; আসিয়ানের আনুষ্ঠানিক সদস্য হয়েছে পূর্ব তিমুর। এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখন সম্পূর্ণভাবে ভৌগোলিকভাবে একীভূত হলো। মাত্র ১৪ লাখ জনসংখ্যার এই দেশ আশা করছে, আঞ্চলিক অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত হয়ে তাদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
পূর্ব তিমুরের প্রধানমন্ত্রী জানানা গুসমাও আবেগঘন বক্তৃতায় বলেন, “আসিয়ানে যোগ দেওয়া আমাদের দেশের জন্য এক স্বপ্নপূরণ।” সেই মুহূর্তে উপস্থিত দর্শকদের চোখ ভিজে যায়। পূর্ব তিমুরের প্রতিনিধি দল কাঁদতে কাঁদতে অন্য দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। এই দৃশ্য প্রমাণ করে, সব ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আসিয়ান এখনও প্রাসঙ্গিক এবং অনেকের কাছে তা এখনও ভালোবাসার এক প্রতীক।
এফএ

