রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

লাখ লাখ নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা

পশ্চিমবঙ্গসহ ১২ রাজ্যে ভোটার তালিকা সংশোধনের ঘোষণা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১৮ পিএম

শেয়ার করুন:

পশ্চিমবঙ্গসহ ১২ রাজ্যে ভোটার তালিকা সংশোধনের ঘোষণা

আগামী ১ নভেম্বর থেকে দেশের ১২টি রাজ্যে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ভোটার তালিকায় ‘নিবিড় সংশোধন’ চালানোর ঘোষণা দিয়েছে ভারতের নির্বাচন কমিশন। পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, কেরালা, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশসহ ১২টি রাজ্যের তালিকায় আসামের নাম নেই। যদিও পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাডুর সঙ্গেই আসামেও ছয় মাসের মধ্যে বিধানসভার নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।

তার আগেই এই নিবিড় সংশোধন বা স্পেশাল ইনটেন্সিভ রিভিশন (এসআইআর) প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় নথি না দেখাতে পারলে বহু মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিরোধী দলগুলো।


বিজ্ঞাপন


কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা দাবি করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো কিছু রাজ্যে বহু কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ভোটার তালিকায় নাম তুলে ফেলেছেন। নিবিড় সংশোধন হলেই বাদ পড়বেন অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গারা।

তবে এই প্রক্রিয়ায় ভারতের মুসলমানদের একাংশের নামও বাদ দিয়ে দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। মুসলমানদের মধ্যেও ভোটাধিকার হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন এমন সামাজিক কর্মকর্তারা।

বিহারে আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে একই ভাবে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন চালিয়ে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষের নাম বাদ দিয়েছে কমিশন। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই বিবাহিত নারী এবং পরিযায়ী শ্রমিক।

নির্বাচন কমিশন কী বলছে?

সোমবার বিকেলে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্য এক সংবাদ সম্মেলনে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের বিস্তারিত ঘোষণা দেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মঙ্গলবার থেকেই এসআইআরের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। তবে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্ম বিলি করা হবে ৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

কুমার বলেন, নিবিড় সংশোধনের উদ্দেশ্য হল যাতে একজনও বৈধ ভোটার তালিকা থেকে বাদ না পড়েন, আর একজনও অবৈধ ভোটারের নাম যাতে তালিকায় না থাকে, সেটি নিশ্চিত করা।

ভোটারদের বাড়ি গিয়ে যে ফর্ম দেওয়া হবে, তার কিছুটা অংশ আগে থেকেই ছাপা হয়ে থাকবে, তবে বাকি অংশটা ভর্তি করতে হবে ভোটারদেরই। এই পর্যায়েই একজন ভোটারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে হবে; তার নিজের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় আছে কি না, তা দেখে লিঙ্ক করতে হবে নিজের নাম।

যদি আগের তালিকায় তার নাম না থাকে, তাহলে তাদের পরবর্তীকালে নোটিশ পাঠাবেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। তখন জন্মের নথি বা অভিভাবকের নথির মতো ১২টি নথি দেখে কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। অনলাইনেও এই প্রক্রিয়ায় নিজের নাম আগের তালিকার সঙ্গে লিঙ্ক করা যাবে বলে জানিয়েছেন কুমার।

এসআইআর নিয়ে কেন উদ্বেগ?

যে কোনো ভোটের আগেই ভোটার তালিকায় সংশোধন ও পরিমার্জন একটি রুটিন প্রক্রিয়া। তবে ২০০২-২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশন সারা দেশে একটি নিবিড় সংশোধন চালিয়েছিল।

বিহারে ওই ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকেই ভিত্তি হিসাবে গণ্য করে এবছর নিবিড় সংশোধন করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও কয়েক মাস আগেই ২০০২ সালের ভোটার তালিকা ওয়েবসাইটে আপলোড করে দেওয়া হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিকত্ব নিয়ে গবেষণা ও আন্দোলন করেন সদ্য কংগ্রেস দলে যোগ দেওয়া অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসু। তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব সুরক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান।

বসু বলেন, বিহারে এসআইআর নিয়ে যেসব জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে, সেগুলোর এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। আগামী ৪ নভেম্বর শুনানি আছে। নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল সেই মামলাগুলো শেষ হওয়ার পরে নতুন করে অন্যান্য রাজ্যে এসআইআর ঘোষণা করা।

‘‘বিহারে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়েছে। তাদের মধ্যে একাংশ মৃত বা স্থানান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু বাদ পড়াদের মধ্যে সিংহভাগই বিবাহিত নারী বা পরিযায়ী শ্রমিক। তারা কিন্তু বিহারের আসন্ন নির্বাচনে আর ভোট দিতে পারবেন না, অন্যদিকে তাদের নাম যে নতুন বসবাসের জায়গায় তোলা হয়েছে, তাও না। অর্থাৎ এই লাখ লাখ মানুষ ভোটাধিকার হারালেন।’’

তবে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার সোমবার সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, বিহারের নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, আবার ২০০২ সালকে কেন ভিত্তি বছর হিসাবে ধরা হচ্ছে, তা নিয়েও আমরা প্রশ্ন তুলেছি।

ভোটারকেই খুঁজতে হবে পুরনো তালিকায় নিজের নাম

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তার দফতরের সূত্রের বরাত দিয়ে কয়েকটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যম কয়েকদিন আগে বলেছিল, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ২০০২ সালের এবং সাম্প্রতিক ভোটার তালিকায় গড়ে ৫০ শতাংশ নামের অমিল পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশন যে প্রাথমিক ম্যাপিং চালিয়েছিল, অর্থাৎ ২০০২ সালের তালিকা আর ২০২৫-এর তালিকায় নামের অমিল কত, সেই হিসাব কষা হয়েছে।

প্রসেনজিৎ বসু বলেন, ২০০২ সালের তালিকাটি ডিলিমিটেশন হওয়ার আগের তালিকা। ওই সময়ে যেসব কেন্দ্র ছিল, তার মধ্যে অনেক কেন্দ্র এখন বিলুপ্ত, আবার কিছু কেন্দ্রকে অন্য কেন্দ্রের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজকের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে সেই সময়ে কোন বুথে ভোট দিতেন একজন মানুষ, সেটা তাকে মনে রাখতে হবে। একজন সাধারণ ভোটারের পক্ষে সেই তথ্য মনে রাখা অসম্ভব। কিন্তু তাকেই নিজের নাম ২২ বছর আগের তালিকা থেকে খুঁজে বার করতে হবে! এই তথ্য তো নির্বাচন কমিশনেরই দেওয়া উচিত।

কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার সোমবার ঘোষণা করেছেন, ভোটারকেই খুঁজে বার করতে হবে যে তার নাম আগের তালিকায় ছিল কি না। তিনি বলেছেন, বড় জোড় বৃদ্ধ, শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক বা স্থানীয় বুথ পর্যায়ের অফিসাররা সহায়তা করতে পারেন।

সমাজ গবেষক সাবির আহমেদ বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি ধরা হয়, এখানে মাত্র ১৫ শতাংশ বাড়িতে ইন্টারনেট আছে, সেখানে কীভাবে গ্রামের, অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ ইন্টারনেট দিয়ে নিজের ভোটাধিকার রক্ষা করবেন? মোবাইল থাকা বা হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড করা আর পুরোনো ভোটার তালিকা থেকে নিজের নাম খুঁজে বের করার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা কি আমাদের নীতি নির্ধারকরা বুঝতে পারছেন না?

মুসলমান আর পরিযায়ী শ্রমিকদের আশঙ্কা

নিজেদের ভোটাধিকার সুরক্ষিত রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে যাদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ মুসলমান বলে দাবি করছেন কয়েকজন গবেষক ও সামাজিক কর্মকর্তা। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে যখন ২০১৯ সাল থেকে আন্দোলন চলছিল, কলকাতায় তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন ফরিদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক দলগুলো এসআইআর নিয়ে এমনভাবে মানুষকে ভয় দেখিয়েছে তারা সত্যিই আতঙ্কিত, অনেকেই মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং তাদের একটা বড় অংশ মুসলমান। বরং কলকাতা শহরে আমি যে অঞ্চলে থাকি, সেখানকার বহু মানুষ জানেনই না এসআইআর ব্যাপারটা।’

সমাজ গবেষক সাবির আহমেদ বলছিলেন, এখন যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা একটা কথা বার বার বলছেন অবৈধ ভোটারে তালিকা ভরে গেছে ইত্যাদি। এত অবৈধ ভোটারই যদি থেকে থাকবে, তাহলে তাদের ভোটেই তো তারাও জয়ী হয়েছেন! দোষটা নাগরিকদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকর।

তার কথায়, ‘মুসলমান এবং আদিবাসীদের এই প্রক্রিয়ায় হেনস্থার মুখে পড়তে হবে। তাদের মধ্যে একটা অক্ষরজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা যেমন আছে, তেমনই বহু মানুষের এই জ্ঞানটাও নেই জরুরি নথি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। আবার মুসলমানদের ক্ষেত্রে একেকজনের নামের নানা বানান হয়। সেগুলোকে এখন বদলাতে গেলে সাইবার ক্যাফেগুলোতে ডিজিটাল ব্রোকার বলে একটা শ্রেণি তৈরি হয়েছে; যারা নথি ঠিক করে দেওয়ার নাম করে অনেক টাকা দাবি করছে। এটা আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা।’

আরেকটি যে শ্রেণির মানুষ আতঙ্কে রয়েছে এসআইআর নিয়ে, তারা হলেন পরিযায়ী শ্রমিক। পশ্চিমবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ কাজের সূত্রে অন্য রাজ্যে থাকেন। তারা বছরে এক কিংবা দু’বার হয়ত বাড়িতে ফেরেন।

এখন এসআইআর করার জন্য যদি তাদের আবারও বাড়িতে আসতে হয়, সেটা একটা বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ বলে জানাচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক। তিনি বলেন, তাদের অনেকেরই জন্মের সার্টিফিকেট বা স্কুল পাশের নথি নেই। সেসব কীভাবে জোগাড় করবেন, কীভাবে জমা দেবেন তারা; এটা ভেবে অনেকেই আতঙ্কিত।

প্রধান নির্বাচনী কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বলছেন, অন্য রাজ্যে যারা কাজের সূত্রে বসবাস করেন, তারা অনলাইনে ফর্ম ভর্তি করে জমা দিতে পারবেন। তবে অনলাইনে ফর্ম ভর্তি করে জমা দেওয়া বা দরকার পড়লে যখন শুনানিতে ডাকা হবে, তখন গ্রামের বাড়িতে হাজির থাকা কতটা বাস্তবসম্মত হবে, তা নিয়ে সন্দিহান আসিফ ফারুক। বিবিসি বাংলা


এমএইচআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর