বন্ধু থেকে হঠাৎ 'শত্রু'তে পরিনত হওয়া ভারতকে বাগে আনতে একের পর ফন্দি আঁটছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুল্ক বৃদ্ধির পর এবার ট্রাম্পের নতুন ভিসানীতির কারণে এবার চরম বিপাকে পড়েছে ভারত।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার এইচ১বি ভিসায় বছরে এক লাখ ডলার ভিসা ফি আরোপ করায় চরম কতটা বিপাকে পড়েছেন ভারতের তরুণেরা!
বিজ্ঞাপন
তাদের স্বপ্নভঙ্গের কথা তুলে আনার চেষ্টা করেছে আল-জাজিরা। মেঘনা গুপ্তা সবকিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। ২৩ বছর বয়সের মধ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করবেন, ভারতে কয়েক বছর চাকরি করবেন এবং তারপর ৩০ বছর বয়স হওয়ার আগেই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাবেন।
এ লক্ষ্যে মেঘনা ভারতের বৃহত্তম আইটি প্রতিষ্ঠান টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেসের (টিসিএস) হায়দরাবাদ অফিসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেছেন।
এ প্রতিষ্ঠানই ভারতকে বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিংয়ের শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি এমন একটি পদোন্নতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যা তাকে ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়েস্ট কোস্টে কাজ করার সুযোগ করে দেবে।
এখন মেঘনা গুপ্তার বয়স ২৯ বছর। তার স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার পথে। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এইচ-১বি ভিসা কর্মসূচিকে ওলট–পালট করে দিয়েছে। এই ভিসা ব্যবহার করেই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো তিন দশকের বেশি সময় ধরে দক্ষ কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসত।
বিজ্ঞাপন
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে এই ভিসার ফি বছরে দেড়ড় হাজার ডলার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ ডলার করা হয়েছে। এই ভিসা ফি বৃদ্ধির ফলে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভিসার নতুন খরচ চাপিয়েছে।
এই ভিসায় মার্কিন আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৭০ শতাংশ দক্ষ কর্মী নিত ভারত থেকে। যেখানে একজন এইচ-১বি ভিসা পাওয়া কর্মীর ন্যূনতম বেতন হওয়ার কথা ৬০ হাজার ডলার, সেখানে এখন নিয়োগকর্তার খরচ ন্যূনতম ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠানই হয়তো কম বেতনে একই দক্ষতার মার্কিন কর্মী খুঁজে নিতে চাইবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী নীতির অংশ হিসেবে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয় দক্ষ কর্মীদের নিয়োগে চাপ দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
কিন্তু বিশ্বের হাজার হাজার তরুণ, যারা এখনো ‘আমেরিকান ড্রিম’ বা মার্কিন স্বপ্নে বিভোর, তাদের জন্য এটি বড় এক ধাক্কা। এই ধাক্কা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে ভারতে।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত অন্য দেশের তুলনায় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে ঠিকই, তবে উন্নত দেশগুলোর কাছে তারা নিজেদের দক্ষ তরুণদের হারাচ্ছে।
বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে বেশি এইচ-১বি ভিসার পৃষ্ঠপোষকতা করত। তারা এই ভিসা ব্যবহার করে ভারতীয় কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেত এবং চুক্তির ভিত্তিতে তাদের দক্ষ কর্মী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সরবরাহ করত।
কিন্তু এই দৃশ্যে পরিবর্তন এসেছে। ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশি এইচ-১বি ভিসা পাওয়া ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭টিই ছিল ভারতীয় বা ভারতে প্রতিষ্ঠিত। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ৪–এ নেমে আসে।
আর ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে মেঘনা গুপ্তার প্রতিষ্ঠান টিসিএস ছিল শীর্ষ ১০ এইচ-১বি ভিসা প্রাপকের তালিকায় একমাত্র ভারতীয় প্রতিষ্ঠান। এ তালিকার বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, মেটা ও অ্যাপলের মতো বড় বড় মার্কিন প্রতিষ্ঠান।
তবে এতদিন যা বদলায়নি, তা হলো মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের এইচ-১বি ভিসায় নিয়োগ করত, তাদের জাতীয়তার পরিচয়। ২০২৪ সালে প্রযুক্তি থেকে শুরু করে চিকিৎসা—এসব খাতে ৭০ শতাংশের বেশি এইচ-১বি ভিসা ভারতীয় নাগরিকদের দেওয়া হয়েছিল। চীনের নাগরিকেরা ১২ শতাংশের কম ভিসা পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল।
এখন ভারতজুড়ে হাজার হাজার তরুণের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার এ পথ সজোরে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
ট্রাম্পের ফি বৃদ্ধি সম্পর্কে আল-জাজিরাকে মেঘনা গুপ্তা বলেন, ‘এতে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।’
ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের ১০ হাজার মানুষের শহর বাগেশ্বরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা গুপ্তা বলেন, ‘আমার সারা জীবনের পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়া। আমার সবকিছু যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।’
মেঘনা গুপ্তা বলেন, ‘তথাকথিত “আমেরিকান ড্রিম” এখন এক নিষ্ঠুর রসিকতার মতো মনে হচ্ছে।’
মেঘনা গুপ্তার সংকটটি আজকের ভারতের এক বৃহত্তর বৈপরীত্যকে তুলে ধরছে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকারের লোকজন প্রায়ই বলে থাকেন, ভারত বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি।
চলতি বছরের শুরুতে জাপানকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জার্মানির পর ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অধিকারী দেশের তালিকায় উঠেছে।
তবে দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ তরুণ কর্মী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তার তুলনায় নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে অনেক কম, যা কর্মসংস্থানের ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ভারতের বড় বড় শহর অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো, খানাখন্দে ভরা রাস্তা, যানজট ও ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের চাপে নুয়ে পড়ছে।
ফলস্বরূপ গুপ্তার মতো লাখ লাখ মানুষ পশ্চিমে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে। তারা প্রকৌশল বা চিকিৎসার মতো পেশা বেছে নেন। ভারতের সেরা কলেজগুলোতে কঠিন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুযোগ পেয়ে লেখাপড়া করে বিদেশে পাড়ি জমান।
গত পাঁচ বছরে ভারত থেকে দক্ষ পেশাজীবীদের বিদেশে যাওয়ার হার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম) ক্ষেত্রে। এই পেশাজীবীরা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে চলে যাচ্ছেন।
ভারতীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯৪ হাজার ১৪৫, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬২৯–এ, অর্থাৎ এই কয় বছরে ২৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ট্রাম্পের নতুন ভিসা নীতি এখন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষ কর্মীদের এই প্রবাহ কার্যত বন্ধ করে দিতে পারে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে বেশ কিছু টানাপোড়েন চলছিল, যার মধ্যে এই ভিসা ফি বৃদ্ধি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের ওপর নয়াদিল্লিকে ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে, যার অর্ধেকই ধার্য করা হয়েছে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এই অর্থ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ক্রেমলিনের যুদ্ধে সহায়তা দিচ্ছে।
দিল্লিভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতের সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা অজয় শ্রীবাস্তব আল-জাজিরাকে বলেছেন, নতুন ভিসা নীতির পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেসব খাত, যেগুলোতে ভারতীয় পেশাজীবীদের আধিপত্য রয়েছে। যেমন মাঝারি স্তরের আইটি পরিষেবা, সফটওয়্যার উন্নয়ন, প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং অর্থ ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাক-অ্যান্ড সাপোর্ট।
শ্রীবাস্তব বলেন, এসব পদে এক লাখ ডলারের বার্ষিক ভিসা ফি অনেকের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে নতুন কর্মীর বার্ষিক বেতনের চেয়েও বেশি, যা ছোট প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতাকে অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক করে তুলবে।
সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা বলেন, একজন বিদেশি কর্মী নিয়োগের খরচ এখন স্থানীয় কর্মী নিয়োগের খরচকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। এটি মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগের হিসাব-নিকাশ বদলে দেবে।
শ্রীবাস্তব বলেন, মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আরও বেশি অভ্যন্তরীণ প্রতিভা খুঁজবে, এইচ-১বি ভিসা শুধু সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের পদগুলোর জন্য সংরক্ষণ করবে এবং সাধারণ কাজগুলো ভারত বা অন্য অফশোর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেবে।
-এমএমএস

