সম্প্রতি জেন-জি দের আন্দোলনে নেপালের রাজনৈতিক পালাবদলের সুযোগে ভারত দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা জোরদার করার সুযোগ পেয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে তারা সতর্ক করেছেন, ভারতের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে না, যা ‘বড় ভাই’ হিসেবে হস্তক্ষেপের ধারণাকে উসকে দেয়। কারণ অতীতে ভারতের এমন ‘দাদাগিরি’ নেপাল ও বাংলাদেশ চীনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বুধবার চীনা সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মনিং পোস্টের এক প্রতিবেদেনে বলা হয়, নেপালের সাম্প্রতিক অস্থিরতার জেরে গত সপ্তাহে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। এরপর গত শুক্রবার দেশটির সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। একই দিনে সংসদ ভেঙে দেন দেশটির রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাউডেল এবং আগামী ৫ মার্চ দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।
বিজ্ঞাপন
এমন প্রেক্ষাপটে নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কিকে অভিনন্দন জানাতে দেরি করেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
দেশটির স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আশা প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে মোদি লেখেন, ‘নেপালের ভাই-বোনদের শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রভাষক ডিবি সুবেদী বলেন, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি স্থিতিশীল প্রতিবেশী অত্যন্ত জরুরি। নেপালের যেকোনো অস্থিরতা ভারতের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় কারণ দুদেশের উন্মুক্ত ও অরক্ষিত সীমান্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, এই অস্থিরতা ভারতের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে যে তারা প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে একত্রে কাজ করে, একটি দায়িত্বশীল উদীয়মান শক্তি হিসেবে কাজ করে
বিজ্ঞাপন
সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামাবাদ ও ঢাকার সঙ্গে দিল্লির বাড়তে থাকা উত্তেজনার দিকেও ইঙ্গিত করে সুবেদি আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ‘বড় ভাই’ বা ‘আঞ্চলিক মোড়ল’ হিসেবে একটি ধারণা বিদ্যমান। তাই নেপালের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ভারতকে কূটনৈতিকভাবে সতর্ক হতে হবে, যেন সেই ধারণা আরও বৃদ্ধি না পায়।
গত এপ্রিলে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে এক হামলায় ২৬ জন ভারতীয় নিহত হন। এ ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত, যদিও ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে। এর জেরে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায় ভারত, পাল্টা হামলা চালায় ইসলামাবাদও, যা কয়েক দশকের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক সংঘর্ষ হিসাবে দেখা হয়।
অন্যদিকে ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কেও টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ বারবার ভারতে অবস্থানরত হাসিনাকে তার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুম সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখোমুখি করার জন্য প্রত্যর্পণের আহ্বান জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে নয়াদিল্লি কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।
এর মধ্যে গত মার্চে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফরের পর বাংলাদেশ ও চীনের সর্ম্পক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তার সফরে উভয় দেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কিছু চুক্তি সই করে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ চীন থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পায়।
এ ছাড়া গত এপ্রিলে বেশ কিছু ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, চীন ভারতের পূর্ব সীমান্তের ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডরের কাছে অবস্থিত কাছাকাছি বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণ করতে পারে।
অর্গানাইজেশন ফর রিসার্চ অন চায়না অ্যান্ড এশিয়া থিংকট্যাংকের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ওমকার ভোলে বলেন, নেপালে জেন-জি আন্দোলনের মূল কারণ ব্যাপক দুর্নীতি ও বেকারত্ব। তার মতে, ভারতের উচিত এই দেশগুলোর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করা, যা দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রযুক্তিগত দক্ষতার কারণে, ভারত নেপালকে ডিজিটাল পেমেন্ট এবং ই-কমার্সের ক্ষেত্রেও সাহায্য করতে পারে।
বেইজিং ইতিমধ্যে কাঠমান্ডুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুশীলা কার্কিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছে এবং বলেছে, তারা নেপালের জনগণের স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়া উন্নয়নপথকে সম্মান করে।
ওমকার ভোলে আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা চীনকে ‘তার উপস্থিতি বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে’, যা অবশ্যই ভারতের স্বার্থের পরিপন্থি। তিনি বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে বলেন, ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়া ভারতের জন্য, বিশেষ করে এর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের মংলা বন্দর সম্প্রসারণ এবং তিস্তা নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য চীনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে নেপালেও বিনিয়োগের করছে চীন, এর মধ্যে তিব্বতের জিলংকে কাঠমান্ডুর সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য একটি প্রস্তাবিত রেলপথও রয়েছে।
এমএইচআর

