শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাপ্রধানদের প্রতি আমেরিকার টান কেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৩৮ এএম

শেয়ার করুন:

পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাপ্রধানদের প্রতি আমেরিকার টান কেন?
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাপ্রধানদের প্রতি আমেরিকার টান কেন?

১৯৫৯ সাল। পাকিস্তানের শাসনভার তখন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের হাতে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে নিজেকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি। এটি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ, যা পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল। তবে আইয়ুব খানের ক্ষমতায় টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তার আমেরিকান বন্ধু, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন।

দুজনের সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল, জনসনের গালে আইয়ুব খানের হাত রেখে ছবি তোলাও বিরল কিছু ছিল না। জনসন করাচির রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, উটের গাড়ি চালকের সঙ্গেও আলাপ করতেন, এমন ছবি পর্যন্ত পাওয়া যায়। সেই বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণা করে আইয়ুব খান একটি বই লিখেছিলেন, শিরোনাম ছিল: Friends, Not Masters। এর উর্দু অনুবাদ ছিল আরও কাব্যিক: Jis Rizq Se Ati Ho Parwaz Mein Kotaahi— অর্থাৎ, ‘যে খাদ্য আমাদের উড়তে বাধা দেয়, তা গ্রহণ করি না।’


বিজ্ঞাপন


তবে বাস্তবতা ছিল ঠিক উল্টো। পাকিস্তানকে খাওয়ানোর প্রয়োজন তখন আমেরিকার ছিল না। কারণ দেশটি ছিল কৃষিনির্ভর এবং জমিও ছিল উর্বর। কিন্তু আইয়ুব খানের প্রয়োজন ছিল মার্কিন সমর্থন, তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমনে এবং সেনাবাহিনীর ভেতর নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে।

এই বন্ধুত্বের বিনিময়ে আইয়ুব খান আমেরিকাকে পাকিস্তানের উত্তরে একটি বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেন। সেখান থেকে আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বিমান পাঠাতে পারত। এই নিপাট কূটনৈতিক সমীকরণ চলেছে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বারবার, এবং বারবারই সেনাশাসকরা ছিলেন সেই সম্পর্কের কেন্দ্রে। গণতন্ত্র নয়, বরং সামরিক নেতৃত্বই বারবার আমেরিকার পছন্দের পাত্র হয়ে উঠেছে।

২০২৫ সালে এসে সেই ইতিহাস যেন আবার ফিরে এসেছে। ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শালের মর্যাদা দেওয়া হয়। তিনি অভ্যুত্থান না করেই প্রথম সেনাপ্রধান হিসেবে হোয়াইট হাউজের আমন্ত্রণ পান। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে ‘সম্মানিত অতিথি’ হিসেবে অভ্যর্থনা জানান। এমনকি পাকিস্তান তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীতও করে।

এদিকে দেশে চলছে ভিন্ন চিত্র। সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান এখন কারাগারে। আদালত, নির্বাচন, সংবাদমাধ্যম— সবকিছু নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর অঘোষিত কর্তৃত্ব। বেছে নেওয়া হয় ক্ষমতাসীন দল, নির্ধারণ করে দেওয়া হয় বিরোধী আসনের সদস্য। এমনকি ভোটের ফলাফলও নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। বিচার বিভাগ কী করবে, সেটিও অনেক সময় নির্ধারিত হয় সামরিক নেতৃত্বের দিক-নির্দেশনায়।


বিজ্ঞাপন


এসবের মাঝেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের কার্যকারিতা তুলে ধরেছে। ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে তারা দক্ষতা ও প্রস্তুতির পরিচয় দিয়েছে, যা মার্কিন সামরিক বিশ্লেষকদের নজর কাড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে, পাকিস্তান এখনো সেই পুরনো মিত্র— ‘যাকে দিয়ে কাজ করানো যায়’। ১৯৮০’র দশকে জেনারেল জিয়া-উল-হক আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার বড় অংশীদার ছিলেন। তার কঠোর শাসনেও ওয়াশিংটনের সমর্থন পেয়েছেন। পরবর্তীতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফও নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা নেওয়ার পর আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হন, বিশেষ করে ২০০১ সালের ৯/১১ ঘটনার পর।

মোশাররফের দাবি অনুযায়ী, এক মার্কিন কর্মকর্তা তখন হুমকি দিয়েছিলেন, পাকিস্তান যদি সহযোগিতা না করে, তবে তাকে ‘পাথর যুগে’ পাঠানো হবে। মোশাররফ সহযোগিতা করেছিলেন। তালেবান নেতা, এমনকি নিরীহ পাকিস্তানিদেরও ধরে ধরে তুলে দেওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। তাদের মধ্যে অনেকে মুখ বেঁধে, হাতকড়া পরা অবস্থায় পাঠানো হয়েছিল গুয়ান্তানামো বে কারাগারে।

এসব ঘটনার পেছনে মূলত একটাই সূত্র, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চেয়ে সেনাশাসনকে বেশি কার্যকর মনে করে। কারণ এতে করে তারা একটি ‘ওয়ান-স্টপ’ অপারেশন চালাতে পারে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি করলেই সব কিছু পেয়ে যায়। বেসামরিক সরকার থাকলে নানা স্তরে আলোচনা, আপস, বিরোধ— এসবের মুখোমুখি হতে হয়।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ছিল ঠান্ডা। তিনি পাকিস্তানকে ‘প্রতারক’ বলেছিলেন। কারণ, আফগানিস্তানে আমেরিকার প্রত্যাশা পূরণে পাকিস্তান সফল হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সেই সম্পর্ক আবার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। সম্প্রতি পাকিস্তান একজন আফগান নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছে, যিনি কাবুল বিমানবন্দরে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ট্রাম্প সেই ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানান।

এদিকে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। আইএসপিআর (পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগ) তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ বার্তাও পোস্ট করতে পারছে না, সেগুলোয় দেখা যায় নিন্দা, বিদ্রুপ, ঘৃণা।

জনগণের চোখে এই সম্পর্কের ফলাফল ভালো হয়নি কখনও। আমেরিকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ পাকিস্তান ৭০ হাজারের বেশি নাগরিক হারিয়েছে। অথচ, এই যুদ্ধ থেকে অর্থনৈতিকভাবে তারা তেমন কোনো লাভ করতে পারেনি। বরং বারবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ঋণ চাইতে হয়েছে।

এ কারণেই সাধারণ মানুষের মধ্যে মার্কিন আধিপত্যবাদ এবং নিজ দেশের সামরিক শাসকদের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে। একবার এক রাজনৈতিক কর্মী মন্তব্য করেছিলেন, “আমরা যখন ক্ষমতায় থাকি এবং কিছু আদায় করতে চাই, তখন শুধু একটা আমেরিকান পতাকা, একটা দেশলাইয়ের কাঠি আর একটা ক্যামেরা দরকার হয়। পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে দেশলাই জ্বালানোর ছবি তুললেই আমেরিকা বুঝে যায় আমাদের ‘বার্তা’। তার পর তাদের অবস্থান বদলে যায়।”

এই ঘটনা আসলে অনেক কিছু বলে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে বন্ধু, আবার প্রভুও। আবার মার্কিন প্রেসিডেন্টদের চোখে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখনো সেই পুরনো মিত্র, যার ‘শিকার ধরার’ ক্ষমতা এখনো অক্ষুণ্ন। তবে জনগণও বুঝে গেছে, এই ‘বন্ধুত্ব’ কখনোই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে না। বরং ইতিহাস বলছে, এর শেষ হয় ধ্বংস, হতাশা আর জনগণের রক্ত দিয়ে। সূত্র: টাইম

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর