বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল কামানের গোলার শব্দ, আর বেইজিংয়ের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সেনাদের প্রথম দলটি। কিন্তু এসবের আগেই সামনে এলো দিনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি। দীর্ঘ সময় ধরে হাত মিলিয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং আনকে স্বাগত জানান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, এরপর অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দিকে। একটু পর বিশ্বের সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত এই দুই নেতাকে পাশে নিয়ে নিজের আসনে বসেন শি।
চীনের সামরিক সক্ষমতার প্রদর্শনীর চেয়ে এই বৈঠকটিই বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিরক্তই বেশি করেছে বলে মনে হচ্ছে। চীনে কুচকাওয়াজ শুরু হওয়ার সাথে সাথে সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে কঠোর ভাষায় একটি বার্তা পাঠান ট্রাম্প, যেখানে তিনি এই তিন নেতার বিরুদ্ধে আমেরিকা-বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন।
বিজ্ঞাপন
পুরো প্যারেড জুড়ে পুতিনকে ডানে এবং কিমকে বামে রেখে প্রেসিডেন্ট শি সম্ভবত এমন প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলেন। এমনকি এই মুহূর্তটি এমন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ক্ষুব্ধ করার জন্যও তৈরি করা হতে পারে, যিনি সম্ভবত বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতেই পছন্দ করেন। তবে সব মনযোগ মূলত নিজের দিকেই টেনে নিয়েছেন চীনা নেতা, যা ব্যবহার করে পূর্বাঞ্চলের-নেতৃত্বাধীন একটি জোটের ওপর নিজের ক্ষমতা এবং প্রভাব জাহির করতে পেরেছেন। এটি এমন একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ট্রাম্পের নেতৃত্বের নানা কারণে বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, তখন শি'র কাছ থেকে এটি একটি জোরালো বার্তা। কিম এবং পুতিন ছাড়াও আরও ২০ জনেরও বেশি বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই সপ্তাহের শুরুতে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে শি'র সাক্ষাৎ নিজেদের মধ্যে সমস্যাগ্রস্ত সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ভারতীয় পণ্য আমদানির ওপর ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের কারণে দীর্ঘদিনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে বলেও মনে হচ্ছে।
বুধবার চীনের এই আয়োজনে মূলত জাপানের বিরুদ্ধে ৮০ বছরের পুরনো বিজয় উদযাপনের কথা ছিল। কিন্তু এটি আসলে সামনে তুলে ধরেছে–– ভবিষ্যতে চীন কোথায় যাচ্ছে সেদিকে এবং একজন বিশ্বনেতা হিসেরে শি-এর ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে। আর পশ্চিমাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো একটি সামরিক বাহিনীও যে চীন গড়ে তুলেছে সেটাও ছিল শি জিনপিংয়ের সামনেই।
বিজ্ঞাপন
চীনের হাতেই এখন ক্ষমতার লাগাম
এই প্রথম একসাথে দেখা গেল শি, পুতিন ও কিমকে। আর তারা একসাথে, ঐতিহাসিক 'গেট অব হ্যাভেনলি পিস' স্কয়ারে উঠলেন সামরিক কুচকাওয়াজ দেখার জন্য। এর প্রতীকী রূপটিও নজর এড়ায়নি।
কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও জেদং ১৯৪৯ সালে দেশটিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১০ বছর পর সেখানেই তিনি কিমের দাদা কিম ইল-সাং এবং তৎকালীন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভকে একটি সামরিক কুচকাওয়াজ দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেবারই শেষবারের মতো এই তিন দেশের নেতারা একসাথে ছিলেন। তখন কোল্ড ওয়ার পরিস্থিতি ছিল তুঙ্গে। বিশ্বের বেশিরভাগ অংশ থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিল চীন, যেমনটি ছিল উত্তর কোরিয়াও। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ধনী।
তবে এখন এই সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী, কিন্তু দরিদ্র দেশ হিসেবে উত্তর কোরিয়ার বেইজিংয়ের সাহায্য প্রয়োজন। আর পুতিনের প্রয়োজন সেই বৈধতা যা শি তাকে দিয়েছেন।
অতীতে পুতিন এবং কিমের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন শি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছিলেন বলেই মনে হয়েছিল। অবশ্য এই ঘটনার নিন্দাও করেননি তিনি। এমনকি রাশিয়াকে সাহায্য করার কথাও অস্বীকার করেছিল চীন। এমনকি রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার সাথে সাথে মনে হচ্ছিল যে তিনি হয়তো পাশে ছিলেন। অর্থ এবং প্রযুক্তির বিনিময়ে পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণকে সমর্থন করার জন্য সৈন্যও পাঠিয়েছেন কিম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শি তার দুই প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, যদিও তারা কিয়েভ আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
কুচকাওয়াজ দেখতে আসা দর্শক এবং দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশে বলেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি বলেন, ‘আজ মানবতা আবারও শান্তি অথবা যুদ্ধ, সংলাপ অথবা সংঘর্ষ, জয় অথবা শূন্যের মধ্যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার মুখোমুখি।’
তিনি ঘোষণা করেন, চীন একটি ‘মহান জাতি যারা কখনো কোনও উৎপীড়নের দ্বারা ভীত হয় না। আর সামরিক কুচকাওয়াজটি ছিল এটিই দেখানোর জন্য যে - এটি ছিল শক্তি, নির্ভুলতা এবং দেশপ্রেমের প্রদর্শন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে চীনের বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৮০ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। যে শব্দ ছড়িয়ে পড়েছিল, ৫০ হাজার দর্শক, যাদের মধ্যে কয়েকজন যুদ্ধের প্রবীণ, নীরব হয়ে থাকা ওই স্কোয়ারের প্রতিটি কোণে। নিজেদের ওপর ঘুরতে থাকা ক্যামেরাগুলো অনুসরণ করে আলাদাভাবে সামনে আসেন গায়ক দলের সদস্যরা। যারা নিখুঁত সুরে গেয়ে ওঠেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া, আধুনিক চীনের অস্তিত্ব নেই।’
প্রেসিডেন্ট শি তার সৈন্যদের পরিদর্শন করার জন্য প্যারেড রুটের পুরোটা গাড়ি চালিয়ে যান, এরপর তার পাশ দিয়ে পা বাড়িয়ে পালাক্রমে এগিয়ে যায় প্রতিটি যুদ্ধ ইউনিট।
চীনের নতুন অস্ত্র প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রথমেই ছিল ট্যাংকগুলো। তবে তার পরের অস্ত্রগুলোর তুলনায় এগুলো পুরনো মনে হচ্ছিল। সমুদ্র, স্থল এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য একটি নতুন পারমাণবিক-সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য হাইপারসনিক জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং লেজার অস্ত্র। এছাড়া ছিল লক্ষ্যবস্তুতে নজরদারি করতে পারে এবং আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ড্রোনও।
বছরের পর বছর ধরে বিশ্বজুড়ে নানা সংঘাতে জড়িত থাকার মাধ্যমে, এখনো হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সুবিধা পাবে, কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে চীন তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য একটি সামরিক বাহিনী তৈরি করছে।
বুধবারের শক্তি প্রদর্শন ছিল ওয়াশিংটন এবং তার মিত্রদের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য অংশের উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি - এমনকি পুতিন এবং কিমের প্রতিও, যারা তাদের লক্ষ্যের তাৎপর্য জানতেন।
চিন্তিত পশ্চিমারা
সামরিক ফ্লাইপাস্ট দেখার জন্য মূল প্যারেড রুট থেকে কিছুটা দূরে চীনের টংহুই নদীর ওপরে একটি সেতুতে জড়ো হয়েছিলেন কিছু সাধারণ মানুষ।
৩০ বছর বয়সী চীনা নাগরিক রং বলেন, ‘এই মুহূর্তটিকে লালন করা আমাদের সবচেয়ে মৌলিক কাজ। আমরা বিশ্বাস করি আমরা ২০৩৫ সালের মধ্যে তাইওয়ান পুনরুদ্ধার করব।’
যে বক্তব্যের ভয়ে ভীত স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানের অনেকেই। চীন অবশ্য বিশ্বাস করে যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ যা একদিন মাতৃভূমির সঙ্গে একত্রিত হবে। যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি শি।
বুধবার তিনি যে অস্ত্র প্রদর্শন করেছেন, তার বেশিরভাগই চীনের নৌ-ক্ষমতার ওপর জোর দিয়েছিল, যা তাইওয়ানের নেতাদের চিন্তায় ফেলতে বাধ্য। এটি অনেক পশ্চিমা দেশকেও উদ্বিগ্ন করবে। বিশেষ করে ইউরোপে, যারা এখনও ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য লড়াই করছে।-বিবিসি বাংলা
এমএইচআর

