চীনের তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন নেতারা অংশ নিয়েছিলেন। এই তালিকায় রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও।
চীন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠক হয়। তিয়ানজিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছেন নরেন্দ্র মোদি।
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে বৈঠকের সময় শি জিনপিং বলেছিলেন, বিশ্বের পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। ভারত এবং চীন শুধুমাত্র দুই প্রাচীন সভ্যতাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে জনসংখ্যা বহুল দেশ এবং একইসঙ্গে গ্লোবাল সাউথের অংশও।
তিনি বলেছিলেন, দুই দেশের জন্য ভালো বন্ধু হিসাবে থাকা এবং ‘একে অপরের সাফল্যে অবদান রাখে এমন অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কথায়, ‘ড্রাগন এবং হাতি একত্রিত হওয়া উচিত।’
একই সুর শোনা গিয়েছে নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠেও। তিনি বলেছেন, ‘দুই দেশের সহযোগিতার সঙ্গে ২৮০ কোটি মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে ভারত বদ্ধপরিকর।’
প্রসঙ্গত, দুই রাষ্ট্রনেতার এমন এক সময় সাক্ষাৎ হয়েছে যখন ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শুল্ক ভারতের রফতানি খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।
বিজ্ঞাপন
অতীতের সীমান্ত নিয়ে বিরোধের বদলে ভারত ও চীন তাদের সম্পর্ক পুনর্গঠনের উপর জোর দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউজ’-এর ড. ক্ষিতিজ বাজপেয়ী বলেছেন, ‘বর্তমান সময়ে বিশ্বে কী কী পরিবর্তন ঘটছে তার উপর দুই দেশের সম্পর্ক নির্ভর করে।’
চীন-ভারত একে অন্যের কাছে কী চায়?
ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, ভারত পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের (পাঁচ লক্ষ কোটি ডলার) শেয়ার বাজার নিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার পথে এগোচ্ছে। অন্যদিকে, চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি।
বেইজিং-ভিত্তিক ‘ওয়েইসওয়া অ্যাডভাইজরি’-র প্রধান নির্বাহী চি-আন লিউ বলেন, ‘চীন ও আমেরিকার সম্পর্ককে বিশ্ব অনেকটাই গুরুত্ব দিয়েছে। এইবার বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির (চীন ও ভারত) কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, সেটা দেখার সময় এসেছে।’ তবে ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত বিরোধ থাকার কারণে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
‘এশিয়া ডিকোড’ নামক অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রিয়াঙ্কা কিশোর বলছেন, ‘দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালুর বিষয়ে ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া ভিসা আরও শিথিল করা যেতে পারে এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক চুক্তিও হতে পারে।’
অ্যান্টন লেভেস্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ (আইআইএসএস)-এর দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার প্রতিরক্ষা, কৌশল ও কূটনীতি বিষয়ক সিনিয়র ফেলো। তার কথায়, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতার জন্য ভারত ও চীনের দিকে তাকিয়ে থাকা দেশগুলোর প্রত্যাশা পূরণের জন্য এই দুই দেশের মধ্যে সংলাপ হওয়া উচিত।’ তবে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ ছাড়াও একাধিক ইস্যু রয়েছে।
এর মধ্যে ভারতে বসবাসকারী বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা দালাই লামা ও ব্রহ্মপুত্র নিয়েও দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের উপর বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করতে চলেছে চীন। ভারত এতে খুশি নয়। একইভাবে পহেলগাম হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটাও এই সম্পর্কের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা ভাল সম্পর্ক নয়।
অন্যদিকে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে চীন।
ভারত ও চীনের ঘনিষ্ঠতা পাকিস্তানকে কী বার্তা দেয়?
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ প্রায় বিশ্বের বিভিন্ন নেতা এসসিও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও ভারত ও পাকিস্তানের সামাজিক মাধ্যমে এই নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে যে ওই দুই দেশের মধ্যে কে চীনের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
তিয়ানজিন বিমানবন্দরে অবতরণের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কয়েকটা ছবি পোস্ট করে প্রধানমন্ত্রী মোদি লিখেছেন, ‘এসসিও সম্মেলনের ফাঁকে বেশ কয়েকটা দেশের নেতাদের সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষায় রয়েছি।’
শাহবাজ শরিফেরও একটা ছবি তার এক্স হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট করা হয়েছিল। ওই পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে যোগ দেবেন এবং বেইজিংয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উদযাপনে অংশগ্রহণ করবেন।’
তিয়ানজিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘পাকিস্তান ও চীনের বন্ধুত্ব পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং প্রকৃত ভালবাসার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। পাকিস্তান ও চীন সমস্ত কঠিন সময়ে একে অপরকে সমর্থন করেছে।বর্তমানে বিশ্বে অনেক পরিবর্তন ঘটছে, তবে আমাদের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হচ্ছে, আমাদের গন্তব্য একই।’
তিনি আরো বলেন, ‘মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তানই প্রথম দেশ যারা চীনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। করাচি থেকে বেইজিংগামী প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইট উড়েছিল ৬০ বছর আগে।’
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক পাকিস্তানের উপর প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পাকিস্তানের উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। বেইজিংয়ের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী ও কৌশলগত।’
চীন বিষয়ক পর্যবেক্ষক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ফজলুর রহমান বিবিসিকে বলেন, ‘চীন ও পাকিস্তানের বন্ধুত্বকে কোনো বাইরের ফ্যাক্টর প্রভাবিত করতে পারবে না। দুই দেশের বন্ধুত্ব এর ঊর্ধ্বে। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতির তেমন একটা সুযোগ নেই।’
তার মতে, বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের (দশ হাজার কোটি ডলারের) বেশি। ভারত তা আরও বাড়ানোর বিষয়ে আগ্রহী। পাশাপাশি চীন থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরেও বিষয়েও আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত।
এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জোহর সলিম অন্য একটা বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদিকিন্তু এর মধ্যে বহু বছর এসসিও বৈঠকে যোগ দেননি। পরিবর্তে তার মন্ত্রীদের মধ্যে কাউকে এই বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। তার মতে, এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের টানাপোড়েন চলছে। এই আবহে ভারত দেখাতে চাইছে, তাদের কাছে বিকল্প হিসাবে অন্য দেশও রয়েছে।
জোহর সালিম আরও বলেছেন, ‘মার্কিন সংস্থাগুলো ভারতে কাজ করছে, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরির সুযোগ কমছে। এই কারণে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে।
‘তাছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কৃতিত্ব দেয়নি ভারত। রাশিয়া থেকে তেল কেনার মতো ইস্যুকে কেন্দ্র করেও ট্রাম্প ক্ষুব্ধ।’
পাকিস্তানের এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মনে করেন, ভারত শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য এই সমস্ত কিছু করছে। এতে খুব একটা গভীরতা নেই। যদিও ভারত ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ পোক্ত।
জোহর সলিমের মতে, ভারত ও চীনের মধ্যে কৌশলগত সংঘাত চলছে এবং তা ‘দীর্ঘ সময় ধরে চলবে’। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, ভারতের মধ্যে বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এই দৌড়ে চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী এবং নিজেদের লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা হিসাবে দেখে।
তিনি বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্বের কোনও সম্ভাবনা নেই এবং শেষ পর্যন্ত ভারতকে তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য পশ্চিমা শিবিরের প্রতি পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই কাজ করতে হবে।’ -বিবিসি বাংলা
এমএইচআর

